
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯’ এর আওতায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে দলটির নাম, প্রতীক, কার্যালয়, সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, পোস্টার, ব্যানার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারসহ যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন থেকে পুরোপুরি বেআইনি হিসেবে গণ্য হবে।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কার্যত দলটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হলো। সোমবার (১২ মে) সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, আইনশৃঙ্খলা উপদেষ্টা করলেন ঘোষণা
এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির এক বিশেষ বৈঠকে। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী ও গণবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। দলটির কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসবিরোধী আইনের পরিপন্থী। অতএব, আইনের আওতায় থেকে তাদের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন থেকে এ নামে কেউ কোনো রাজনীতি করতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত এককভাবে নেওয়া হয়নি। আমরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক, নিরাপত্তা, বিচার ও রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সর্বসম্মতভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। দেশকে সন্ত্রাস, নিপীড়ন, গুম, খুন এবং নির্বাচনবিহীন শাসন থেকে মুক্ত করতেই এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল।”
প্রজ্ঞাপনের বিস্তারিত
সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়:
“সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৭(১) অনুযায়ী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হলো। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর দলটির যেকোনো ধরনের সভা, সমাবেশ, অফিস পরিচালনা, অর্থ লেনদেন, কর্মসূচি ঘোষণা, নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কিংবা তাদের নাম ও প্রতীক ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, “সরকার দীর্ঘদিন ধরে তথ্য সংগ্রহ, তদন্ত, গোয়েন্দা নজরদারি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই দলের অধীনে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভোটাধিকার হরণ এবং বাকস্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
আলোচিত নিষেধাজ্ঞা, মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সরকারের এ সিদ্ধান্তে দেশে ও বিদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সমর্থক মহলে স্বস্তি প্রকাশ করা হলেও, একাংশ একে রাজনৈতিক প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করেছে।
তবে সরকারের বক্তব্য, এটি কোনো প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী একটি অনিবার্য ব্যবস্থা।
জাতীয় রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একসময় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া ঐতিহাসিক দল হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা একচ্ছত্র শাসনের মাধ্যমে গণতন্ত্র হরণকারী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করে। এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দেশ একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করছে—যেখানে শাসকগোষ্ঠীকে জবাবদিহির আওতায় আনা, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সরকার জানিয়েছে, নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে এবং কারও বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ বা জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে সংসদে আওয়ামী লীগের আসন, তাদের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটির অবস্থান এবং দলীয় ব্যাংক হিসাবগুলো কীভাবে নিষ্পত্তি হবে, সে বিষয়েও সরকার শিগগিরই বিস্তারিত নির্দেশনা দেবে বলে জানা গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ