
ছবি: সংগৃহীত
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে চিকিৎসকদের চিন্তাধারা ও মনোভাবের আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আমরা যদি নিজের মন ঠিক করে নিতে পারি, তাহলে সীমিত সামর্থ্যেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে ২৫ শতাংশ অগ্রগতি সম্ভব।” তিনি চিকিৎসকদের দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
আজ সোমবার সকালে ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ‘সিভিল সার্জন সম্মেলন – ২০২৫’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দেশের ৬৪ জেলার সিভিল সার্জনদের অংশগ্রহণে আয়োজিত এই দুইদিনব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়েছে আজ। স্বাস্থ্যখাতের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয়তা সরাসরি নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই আয়োজন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ড. ইউনূস বলেন, “সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে অনেক জিনিস সমাধান হয়ে যায়। অনেক প্রশ্ন মিটে যায়। আমি আশা করি, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়ার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এবং মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্র আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবো।”
তিনি স্বীকার করেন, স্বাস্থ্যখাত একটি চ্যালেঞ্জিং সেক্টর—যেখানে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, জনবল সংকট ও সরঞ্জামের ঘাটতি বিদ্যমান। তবে এসব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একটি সদিচ্ছা ও ইতিবাচক মনোভাব থাকলে ভালো ফল সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা স্বাস্থ্যখাত নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করি। কেউ চিকিৎসা পেল না, তাহলে দোষ দিই হাসপাতালকে; আবার হাসপাতালে শুনি ওষুধ নেই, তখন দোষ দিই মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু আমরা নিজেরা কোথায় ঘাটতি রেখেছি, সেটা কি একবারও নিজেকে জিজ্ঞেস করি?”
তিনি চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আসেন, তাহলে স্বাস্থ্যখাত আপনাদের হাত ধরেই বদলে যাবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো কিছু করা যায়—সেই আত্মবিশ্বাস আমাদের থাকতে হবে।”
স্বাস্থ্যখাতে কাঠামোগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যসেবায় কাঠামোর প্রয়োজন নেই যতটা না প্রয়োজন মানবিকতা ও আন্তরিক সেবার মানসিকতা। একজন চিকিৎসক যদি আন্তরিকভাবে রোগীকে দেখে, তাহলে সে রোগী অন্তত আশ্বস্ত হয়ে যায়। এটা একটা বিশাল মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি।”
ড. ইউনূস বলেন, “আজকের এই সম্মেলন নতুন মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন। এখান থেকেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত একটি নতুন পথচলা শুরু করলো। এই পথচলায় প্রশাসনের পাশাপাশি আপনাদের মানসিক প্রস্তুতিই হবে মূল চালিকাশক্তি।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমাদের কোনো রাজনীতি নেই। এটা মানুষের মৌলিক অধিকার। এই খাতকে রাজনীতিমুক্ত রেখে আমরা জনমানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। আমরা চাই, দেশের প্রতিটি মানুষ ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পাক—সে শহরে থাকুক বা প্রত্যন্ত গ্রামে।”
তিনি সিভিল সার্জনদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা জেলা পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। আপনাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাই নির্ধারণ করবে, সাধারণ মানুষ কীভাবে সরকারকে দেখছে। তাই নিজেদের দায়িত্ব শুধু চাকরি নয়—একটি মহান ব্রত হিসেবে দেখতে হবে।”
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম তার বক্তব্যে বলেন, “সিভিল সার্জন সম্মেলন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমরা চাই, মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা, সংকট ও সাফল্যের গল্পগুলো জাতীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হোক। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি নতুন ধারার সূচনা করলাম।”
তিনি সিভিল সার্জনদের আরো বলেন, “আপনারা জনগণের সবচেয়ে কাছের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। জনগণের আস্থা ও ভরসা অর্জনের দায়িত্ব আপনাদের হাতে। স্বাস্থ্যখাতে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি মাঠপর্যায়ে যারা আছেন, তাদের হাতে।”
প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই সিভিল সার্জন সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তাবনা নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করা। দুদিনব্যাপী এই সম্মেলনে জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, বাজেট ব্যয়, ওষুধ সরবরাহ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, জনবল ব্যবস্থাপনা ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেম নিয়ে ৮টি আলাদা সেশন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এই আহ্বান বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে নতুন ভাবনা ও দায়িত্ববোধের বার্তা বহন করে। কাঠামোগত ঘাটতি নয়, মানসিক পরিবর্তনই হতে পারে স্বাস্থ্যখাতের বাস্তব উন্নয়নের চাবিকাঠি—এই বোধ নিয়ে দেশের চিকিৎসকদের কাজ শুরু করার এখনই সময়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ