
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের ৭ মে পর্যন্ত দেশে এসেছে ২৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী দেশের ইতিহাসে কোনো একক অর্থবছরে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
প্রবৃদ্ধির চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের সোমবার (১২ মে) প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস এবং মে মাসের প্রথম সাত দিন মিলিয়ে দেশে এসেছে ২ হাজার ৫২৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। গত অর্থবছরের এই সময় পর্যন্ত দেশে এসেছিল ১ হাজার ৯৭২ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৫৫৫ কোটি ডলার, যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ২৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার শ্রমবাজারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার বৃদ্ধিই এই আয়ের বড় কারণ। এছাড়া ডলার প্রণোদনা (বর্তমানে ২.৫ শতাংশ) এবং ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করলে দ্রুত টাকা পৌঁছানোর সুবিধাও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এক মাসেই সর্বোচ্চ আয়
চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশে এসেছে ৩২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে কোনো একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আয়। এর আগে এতো বেশি রেমিট্যান্স কখনোই আসেনি। মার্চ মাসের এই রেমিট্যান্স দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। এটি শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভই বাড়ায়নি, বরং সরকারের রাজস্ব আদায় এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
মার্চের পর এপ্রিল মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল বেশ চাঙ্গা। ওই মাসে দেশে এসেছে ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ ডলার, যা ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একক মাসের রেমিট্যান্স। ফেব্রুয়ারিতে এই পরিমাণ ছিল ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার এবং জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
মে মাসেও রেকর্ডের ধারাবাহিকতা
২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম ৭ দিনেই দেশে এসেছে ৭৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। গত বছরের মে মাসের প্রথম ৭ দিনে দেশে এসেছিল ৬০ কোটি ১০ লাখ ডলার। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, চলতি বছরের ৭ মে একদিনেই দেশে এসেছে ১১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা দিনের হিসাবে অত্যন্ত চমকপ্রদ।
অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব
অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপমুক্ত হয়, আমদানি ব্যয় নির্বাহ সহজ হয় এবং টাকার মান স্থিতিশীল থাকে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতার মধ্যেও এই রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় স্বস্তি এনে দিয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুল বারী বলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সরকার যদি দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়ায়, তবে এই ধারা আরও দৃঢ় হবে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “রেমিট্যান্স প্রবাহে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে প্রবাসীরা আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে ফিরে এসেছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকে শক্তিশালী করবে।”
সরকারের উদ্যোগ
সরকার গত কয়েক বছর ধরে রেমিট্যান্স প্রেরণে হুন্ডি প্রতিরোধ, ব্যাংকিং সুবিধা উন্নয়ন এবং প্রণোদনার মাধ্যমে প্রবাসীদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে দ্রুত টাকা পাঠানোর সুবিধা, রেমিট্যান্স অ্যাপ এবং বিশেষ ডলারের দর সুবিধাও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ যদি দক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকদের আরও বড় পরিসরে বৈদেশিক শ্রমবাজারে পাঠাতে পারে, তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে। পাশাপাশি, হুন্ডি প্রতিরোধে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।
এই অভাবনীয় রেমিট্যান্স অর্জন দেশের অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে চাঙ্গা রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সংকট উত্তরণেও বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে প্রবাসীদের আস্থা অটুট রাখার পাশাপাশি শ্রমবাজারে আরও সুযোগ তৈরি করা জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ