
ছবি: সংগৃহীত
দেশের পুঁজিবাজারকে দীর্ঘদিনের ধ্বংসাত্মক লুটপাট ও অনিয়ম থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে একগুচ্ছ কৌশলগত নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং এই খাতকে অর্থনীতির একটি কার্যকর সহায়ক শক্তিতে পরিণত করতে তিনি পাঁচটি স্পষ্ট ও কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে বাজারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির অংশীদারিত্ব হ্রাস, বড় দেশীয় কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি, বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে সংস্কার কার্যক্রম, অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহ দেওয়া।
রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে তিনি এসব নির্দেশনা প্রদান করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
নির্দেশনা ১: রাষ্ট্রায়ত্ত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার ছাড়তে হবে
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সরকারের মালিকানাধীন যেসব বহুজাতিক বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর কিছু অংশ পুঁজিবাজারে ছাড়ার মাধ্যমে বাজারে গভীরতা তৈরি করা জরুরি। সরকারের অংশীদারিত্ব সীমিত রেখে এসব কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা হলে বাজারে পেশাদারিত্ব, জবাবদিহিতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।”
নির্দেশনা ২: বড় দেশীয় কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি
তিনি বেসরকারি খাতের বড় দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে যারা এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি, তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে বলেন। এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও নীতিগত সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন। ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশে অনেক লাভজনক ও শক্তিশালী কোম্পানি রয়েছে যেগুলো এখনো পুঁজিবাজারে আসেনি। তাদের আসা বাধ্যতামূলক না হলেও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।”
নির্দেশনা ৩: বিদেশি বিশেষজ্ঞ দিয়ে সংস্কার
সবচেয়ে স্পষ্ট এবং কঠোর নির্দেশনা ছিল পুঁজিবাজার সংস্কারের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, “দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহল পুঁজিবাজারকে ধ্বংস করেছে। এর পুনর্গঠন অভ্যন্তরীণভাবে সম্ভব নয়। তাই বিদেশি পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।”
তিনি জানান, বাজারের স্বচ্ছতা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, স্বয়ংক্রিয় নজরদারি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
নির্দেশনা ৪: অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যারা গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বাজার থেকে লুটপাট চালিয়েছে, তাদের বিচার না হলে সাধারণ মানুষ আস্থা পাবে না। এদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শেয়ারবাজারকে যে অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা অকল্পনীয়। এটি যেন আর লুটেরাদের আড্ডাখানায় পরিণত না হয়, সেজন্য আমাদেরকে কঠোর নজরদারি এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
নির্দেশনা ৫: ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ
এসময় তিনি বলেন, “বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো শুধু ব্যাংক নির্ভর হয়ে আছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে অনিরাপদ ঋণ বাড়ছে এবং একই সঙ্গে পুঁজিবাজার উপেক্ষিত থাকছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে উৎসাহিত করতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল আহরণের পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান লক্ষ্য
পুঁজিবাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দেখা যাচ্ছে। একের পর এক কারসাজি, মনোপলি নিয়ন্ত্রণ, আইনের শিথিল প্রয়োগ এবং জবাবদিহির অভাবে এই বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এই বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া এই নির্দেশনাগুলোকে বিশ্লেষকরা যুগান্তকারী বলছেন, যদি তা বাস্তবায়নে কঠোরতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়।
বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “পুঁজিবাজার আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় একটি খাত। কিন্তু তা আজ চরম অবহেলিত, অনিয়মে পরিপূর্ণ। এখনই সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে এ খাত আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।”
বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও পুঁজিবাজার সংস্কারে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেন এবং আগামী ১৫ দিনের মধ্যে একটি সময়সূচিভিত্তিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ