
ছবি: সংগৃহীত
দেশের শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা এই বাজারের বর্তমান অবস্থা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর শেয়ারবাজারের সংকট উত্তরণের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশা পাল্টে গেছে। অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে, বাজারে দর পতন অব্যাহত রয়েছে এবং লেনদেনের পরিমাণও নেমে গেছে তলানিতে। দেশের অর্থনীতির কিছু সেক্টরে উন্নতি দৃশ্যমান হলেও শেয়ারবাজার সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না।
প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৯ মাসে ৩০ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে নিজেদের শেয়ারবাজারে থাকা অ্যাকাউন্ট (বিও) বন্ধ করে দিয়েছেন। আর ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী বর্তমানে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছেন। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক এক হাজার পয়েন্টেরও বেশি কমে গেছে, যা বাজারের মারাত্মক ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বর্তমান সংকট সামাল দিতে সক্ষম হয়নি, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্রমাগত ক্ষয় পাচ্ছে।
বিভিন্ন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করছেন যে বিএসইসি, যাদের দায়িত্ব ছিল শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বর্তমানে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজারের মধ্যস্থতাকারীদের সম্পর্ক এখন একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এটি বাজারের জন্য একটি খারাপ সংকেত।” বিশেষ করে বিএসইসি’র একাধিক সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজারে গভীর অনাস্থা তৈরি হয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ সম্প্রতি ১৬ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার পর এসব বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে।
ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক (ডিএসইএক্স) ১,১১৩ পয়েন্ট হারিয়ে ৪,৯০২ পয়েন্টে নেমেছে। এটি গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন এবং বিশ্বের অন্য কোথাও এত বড় পতন ঘটেনি। বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা এক ধরনের সংকেত, যে শেয়ারবাজারে এখন আস্থা হারানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে, ৩৬০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ৩৩৬টির শেয়ারের দাম কমেছে এবং ৩৭টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের ২৭টির দাম কমে গেছে। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এই ধারাবাহিক ক্ষতি সহ্য করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারে প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে, যেমন: বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ এবং মূলধনি মুনাফার ওপর কর ছাড় দেয়া হবে এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ভালো কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণীয় হারে কর ছাড় দেয়া হবে। তবে বাজারের এই সমস্যাগুলি শুধু বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে সমাধান হবে বলে মনে হয় না, বরং নীতিগত পরিবর্তন এবং কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন।
বিনিয়োগকারীরা এখন আর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। বিএসইসি’র কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল, শেয়ারবাজারে অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক মাসে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে সেই আস্থা ফেরাতে পারছে না বিএসইসি। এদিকে, অনেক ব্রোকারেজ হাউস এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, বর্তমান শেয়ারবাজারের দুরবস্থা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেছেন, “বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে তাদের অস্বস্তি দূর করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।” তিনি মনে করেন, সরকার যদি কেবল বাজেটের সহায়তার কথা বলে, তবে এর মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যার সমাধান হবে না। এই বাজারের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অন্তর্নিহিত সমস্যা সমাধান করা উচিত।
বর্তমান শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের পদক্ষেপের বাইরে কোনো জাদু করা সম্ভব নয়। সরকারের ট্যাক্স সুবিধা এবং অন্য প্রণোদনা প্রদান করলেও, শেয়ারবাজারে আস্থাহীনতা দূর করার জন্য অবিলম্বে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। শুধু বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা কম।
এরই মধ্যে অনেক বিনিয়োগকারী এবং বাজার বিশ্লেষক শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে দাবি জানাচ্ছেন। এসব অবস্থা দেখার পর, এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারের সংকট উত্তরণে সরকারের আগ্রহ এবং পদক্ষেপের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ