
ছবি: সংগৃহীত
দেশে এখন চলছে বোরো মৌসুম। এই সময় কৃষকের ঘরে নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। বিশেষ করে মিনিকেট চালের দাম দুই সপ্তাহে কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু একই সময়ে ভোক্তাদের জন্য স্বস্তির খবর এখানেই থেমে গেছে। কারণ সবজি, ব্রয়লার ও দেশি মুরগি, ডিম এবং পেঁয়াজের দাম এখনো আকাশচুম্বী, যা সাধারণ ক্রেতাদের ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার, হাতিরপুল বাজার, পল্লবীর মুসলিম বাজার, বউবাজার ও মিরপুর ১১ নম্বর কাঁচাবাজারে কয়েকদিনের ব্যবধানে চালের দাম কিছুটা কমলেও অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমাগত চড়ায় অবস্থান করছে। ভোক্তা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে বাজারের এই পরিস্থিতির বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে।
বাজারে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুচরা দোকানে এখন জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নতুন মিনিকেট চাল যেমন ডায়মন্ড, মঞ্জুর, রশিদ প্রভৃতি ব্র্যান্ড ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এই চালের কেজি ৮৮ থেকে ৯০ টাকা ছিল।
এছাড়া সাগর মিনিকেটের দামও ৭৮ থেকে কমে ৭৫ টাকা হয়েছে। তবে অন্য ধরনের চাল যেমন– নাজিরশাইল, আতপ বা বাসমতি চালের দামে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, বোরো ধানের ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে নতুন চাল সরবরাহ বাড়ছে। মিনিকেট চাল মূলত ছাঁটাই করা চাল, যা বোরো ধান থেকেই তৈরি হয়। মৌসুমি উৎপাদনের প্রভাবে এর দাম এখন নিচের দিকে।
চালের দাম কমলেও সাধারণ মানুষের জন্য বাজারের বড় দুশ্চিন্তার নাম এখন সবজি। ঈদের পর থেকেই সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী, আর এখন তা স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
এক সময় যেসব সবজি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সস্তার উৎস ছিল, সেগুলোর দাম এখন চমকে দেওয়ার মতো।
উদাহরণস্বরূপ,
-
পেঁপে: কেজি ৮০ টাকা
-
করলা, বরবটি, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, পটল, ঢ্যাঁড়স, লতি: ৬০ থেকে ৮০ টাকা
-
আলু, কাঁচকলা, মিষ্টিকুমড়া ছাড়া আর কোনো সবজি ৫০ টাকার নিচে নেই
ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণেই দাম এতটা বেড়েছে। কোনো কোনো পাইকারি বাজারেও একাধিক সবজি অপ্রতুল বা নিম্নমানের পাওয়া যাচ্ছে, যার ফলে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশের বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা এবং সোনালি মুরগি প্রকারভেদে ২৬০ থেকে ৩১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাত্র ১৫-২০ দিন আগেও এই মুরগিগুলোর দাম ছিল ২০ থেকে ৩০ টাকা কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রজনন খামারে উৎপাদন কমে যাওয়া, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে এই দাম বাড়ছে।
ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম দুই সপ্তাহ আগে যেখানে ডজনে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা ছিল, এখন তা বেড়ে ১৪৫ টাকা পর্যন্ত উঠে গেছে। বিশেষ করে মিরপুর ১১ নম্বর কাঁচাবাজারে ডিম ব্যবসায়ী সবুজ আহমেদ জানান, “আমরা এখন বেশি দামে ডিম কিনছি, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি। দাম একটু বেশি হলেও আমাদের লাভের মার্জিন খুব কম।”
ডিমের দামের এই বাড়তি চাপ সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে, যারা সস্তা প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডিমের ওপর নির্ভর করে থাকে।
এক সময় ৩০-৪০ টাকায় পাওয়া যেত দেশি পেঁয়াজ, এখন খুচরা বাজারে কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর পাড়া-মহল্লার দোকানে এই দাম আরো ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি। পেঁয়াজের আমদানির ওপর নির্ভরতা, মৌসুমি ঘাটতি এবং মজুতদারদের কারসাজির অভিযোগ থাকলেও সরকারি মনিটরিং যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে।
মাংসের দামে কিছুটা স্থিতিশীলতা থাকলেও তা এখনো নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
-
গরুর মাংস: ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা
-
খাসির মাংস: ১ হাজার থেকে ১,৫০০ টাকা
অন্যদিকে, মাছের বাজারেও তেমন পরিবর্তন নেই।
-
চাষের কই: ৩০০-৩২০ টাকা
-
তেলাপিয়া: ২২০-২৫০ টাকা
-
পাঙাশ: ২০০-২৫০ টাকা
-
রুই: ৩৫০-৪০০ টাকা
-
পাবদা: ৪০০-৫০০ টাকা
এসব দামে কিছুদিন ধরেই মাছ বিক্রি হলেও গুণগত মানে হেরফের থাকায় অনেকেই দামে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।
বাজারে আসা এক ভুক্তভোগী ক্রেতা বলেন, “চাল ছাড়া আর কোনো জিনিসের দাম কমেনি। মাছ, মাংস তো আগেই কেনা বাদ দিয়েছি। এখন সবজি, ডিম—সবই হাতের বাইরে।”
একজন বিক্রেতা বললেন, “আমরা চাইলে তো আর দাম বাড়াতে পারি না, পাইকারি বাজারে যেভাবে পাই, সেভাবেই বিক্রি করতে হয়। এখন সরবরাহ কম, দাম বেশি—আমরাও বিপাকে।”
চালের দামে স্বস্তি এলেও বাজারের সামগ্রিক চিত্র বলছে—গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমেনি বরং বেড়েছে। বিশেষ করে সবজি, ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ সামলানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।
অতএব, শুধু চালের দাম কমলেই চলবে না, দরকার সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ