
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান সীমান্ত উত্তেজনা আরও ঘনীভূত হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক দাবি ঘিরে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাতে শুক্রবার প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গতরাতেই অন্তত ৪৮টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। এ নিয়ে চলতি সপ্তাহে পাকিস্তান কর্তৃক ভূপাতিত ড্রোনের সংখ্যা ৭৭-এ পৌঁছেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশী পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে রণংদেহী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
ড্রোন ধ্বংসের নতুন রেকর্ড দাবি
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা পিটিভি নিউজ জানায়, বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন অংশে ঢুকে পড়া ভারতীয় হ্যারপ ধাঁচের নজরদারি ও হামলাকারী ড্রোনগুলো গুলি করে নামায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আইএসপিআর (Inter Services Public Relations)-এর বরাত দিয়ে বলা হয়, এদিন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (আজাদ কাশ্মীর) এবং পাঞ্জাব সীমান্তে সক্রিয় ছিল ভারতীয় ড্রোনগুলো, যেগুলোর বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধ সক্ষমতায় উন্নত ও উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন।
এর আগে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও ২৫টি ড্রোন ধ্বংসের দাবি করে আইএসপিআর। অর্থাৎ মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে পাকিস্তান ভূপাতিত করেছে ৭৩টি ড্রোন, যা এধরনের সংঘাতে এক নজিরবিহীন পরিসংখ্যান।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সূত্রগুলো বলছে, এই ড্রোনগুলো সীমান্তে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি কিছু স্থানে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে হামলা চালানোরও চেষ্টা করছিল। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির কারণে সেগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস হয়ে যায়।
পাল্টাপাল্টি হামলায় প্রাণহানি বাড়ছে
সীমান্ত উত্তেজনার সূচনা ঘটে গত মঙ্গলবার (৬ মে) রাত ১টার পর, যখন ভারত 'অপারেশন সিঁদুর' নামে একটি সামরিক অভিযান চালায়। পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী, পাঞ্জাব ও আজাদ কাশ্মীরের অন্তত ১১টি স্থাপনায় এই হামলা হয়। ব্যবহার করা হয় ক্ষেপণাস্ত্র, গুলি ও বোমা। এতে অন্তত ৩১ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত এবং ৫৭ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির আইএসপিআর।
অন্যদিকে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, মঙ্গলবার রাতেই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর থেকে এলওসি (লাইভ অব কন্ট্রোল) বরাবর ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর অংশে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হয়। এতে ১৬ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয় এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এলওসি’র বিভিন্ন গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিতেরও দাবি
ড্রোনের পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে—
তিনটি রাফাল (ফ্রান্স নির্মিত)
একটি সু-৩০ (রাশিয়ার তৈরি)
একটি মিগ-২৯ (সোভিয়েত আমলের)
এই দাবিগুলো পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র নিজেই বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, “ভারতের আগ্রাসনের জবাবে আমরা জবাব দিতে সক্ষম এবং প্রস্তুত। আমরা শুধু প্রতিরক্ষা করছি না, শত্রুপক্ষকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে দিচ্ছি।”
আজ শুক্রবার সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি করা হয়েছে। তবে ভারতীয় পক্ষ এসব দাবিকে “অতিরঞ্জিত ও ভিত্তিহীন” বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
উত্তেজনার সূত্রপাত: পেহেলগামের হামলা
এই সংঘর্ষের পেছনে প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটায় ২২ এপ্রিল তারিখে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর এক বন্দুকধারী হামলা। ওই হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় পর্যটক ছিলেন। এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দায়ী করে ভারত, এবং এর প্রতিশোধ নিতেই সীমান্তে “সুনির্দিষ্ট অভিযান” চালায়।
পাকিস্তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, ভারত নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে সীমান্ত উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে এবং যুদ্ধ চায়।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই সংঘর্ষে এখনো পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী প্রকাশ্যে জড়িত হয়নি। তবে কূটনৈতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। জাতিসংঘ, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ-এর পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের এই পাল্টাপাল্টি আগ্রাসন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে, যা শুধু এই দুই দেশের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য হুমকি।
সার্বিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত
বর্তমানে সীমান্তজুড়ে উচ্চমাত্রার সতর্কতা জারি রয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলছে, সীমান্তবর্তী এলাকায় ‘রেড এলার্ট’ অব্যাহত রয়েছে। ভারতও সেনা ও বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।
সীমান্তে বসবাসকারী হাজার হাজার সাধারণ মানুষ এখন ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই সীমান্তবর্তী গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যতদিন না কোনো কূটনৈতিক সমাধান বের হচ্ছে, ততদিন এই উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং উভয় পক্ষই আরও শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ