
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর খাতকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা, তবে এই সম্ভাবনাকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ জনশক্তি এবং প্রযুক্তি সহায়তার সমন্বয়ে আগামী পাঁচ বছরে এ খাতে বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়ন আকর্ষণ সম্ভব বলে মনে করছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন (আশিক চৌধুরী)।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। দেশের প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প খাতে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প—এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা।
বিডা চেয়ারম্যান জানান, বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজার প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার। অথচ বাংলাদেশ এই বিশাল বাজার থেকে অর্জন করছে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলার। এর একটি বড় অংশও দেশের বাইরে কর্মরত বাংলাদেশিদের মেধার ফল। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বহু মেধাবী তরুণ সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছেন। তারা যদি দেশে থেকে এই শিল্পে অবদান রাখার সুযোগ পায়, তাহলে এ খাত থেকেই বড় আকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব।”
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “আমরা দেখছি, প্রযুক্তির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাংলাদেশ এখনও সেভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো দক্ষতা, অবকাঠামো ও নীতিগত সহায়তার ঘাটতি। এই ঘাটতি পূরণে সরকার কাজ শুরু করেছে। এখন থেকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।”
তিনি আরও জানান, “সরকার এই শিল্পে আগ্রহী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা এই খাতে অভিজ্ঞ, প্রয়োজনে তাদের বাংলাদেশে এনে কাজ করানো হবে।”
সেমিকন্ডাক্টর খাতের ভেতরের সম্ভাবনার দিকটি তুলে ধরে বিডার চেয়ারম্যান বলেন, “চিপ ডিজাইন, প্রটোটাইপ তৈরি, টেস্টিং, অ্যাসেম্বলি ও প্যাকেজিং—এই কাজগুলো বাংলাদেশেই করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনশক্তি, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং উন্নত অবকাঠামো।”
তিনি বলেন, “বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের চেইনে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ হতে পারে চিপ ডিজাইন ও প্যাকেজিং। কারণ এই দুটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং অবকাঠামোর প্রয়োজন হয় না, তবে উচ্চ দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা অত্যন্ত জরুরি।”
বিডা চেয়ারম্যান জানান, এই শিল্পে প্রবেশের জন্য বহুস্তরভিত্তিক স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রযুক্তিভিত্তিক পাঠক্রম চালুর সুপারিশ এসেছে।
“সরকার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। ইতিমধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিকে পরীক্ষামূলক প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে,” যোগ করেন আশিক চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে বিডা চেয়ারম্যান জানান, সম্প্রতি গঠিত জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্স দেশের এই সম্ভাবনাময় খাতের উন্নয়নে নীতিগত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স মোট ২৩টি সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে।
এই সুপারিশে রয়েছে—
জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর নীতিমালা প্রণয়ন
কর অবকাশ ও প্রণোদনা প্রদান
সাপ্লাই চেইনের পরিবেশ উন্নয়ন
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলে কারখানা স্থাপন
গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বাজেট বৃদ্ধি
বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে আনায়নে ভিসা ও কর সুবিধা
দেশে চিপ ডিজাইন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের স্থানীয় মেধাবীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, পাশাপাশি যারা বিশ্বের বড় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিতে কাজ করছেন, তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে তাদের হায়ার করতে হবে। আমরা চাই, এই শিল্পে একটি গ্লোবাল ট্যালেন্ট পুল তৈরি হোক।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতকে বিশ্বমানের করতে হলে শুধু দেশীয় সক্ষমতার ওপর নির্ভর করলেই হবে না। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করাও জরুরি। এজন্য আমরা বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা করার উদ্যোগ নিচ্ছি।”
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। বিডা’র সর্বশেষ পরিকল্পনা ও সরকারের সদিচ্ছা ইঙ্গিত দিচ্ছে, এবার বাস্তবায়নপর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশের প্রযুক্তিভিত্তিক এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি। যদি প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো, বিনিয়োগ পরিবেশ ও নীতিগত সহায়তার ভারসাম্য রক্ষা করা যায়—তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই কয়েকশো মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ বাংলাদেশে সম্ভব, যা ডিজিটাল অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও মজবুত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ