
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রে পরিণত হওয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি নিয়ে চলছে জোরালো দরকষাকষি। বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের সঠিক ভারসাম্য রক্ষায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বাংলাদেশ। যদিও দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মতবিরোধ থেকে শুল্ক চুক্তির খসড়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
বুধবার ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা (ইউএসটিআর) ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ওয়াশিংটনস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এবং অনলাইনে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বৈঠকে যুক্ত ছিলেন। বৈঠকে শুল্ক চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে না পারায় পরবর্তী আলোচনা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৮ জুলাই আবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে যেখানে ইউএসটিআরের সঙ্গে এই ইস্যুতে চূড়ান্ত দরকষাকষি করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এই আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য শনিবার ওয়াশিংটনে যাত্রা করবেন। তিনি ৯ জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে থাকবেন এবং ইউএসটিআর সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, গত বছর ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আমদানিকৃত বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়, যা দেশের রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এতে কিছু শর্ত রয়েছে যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে বাংলাদেশ মনে করছে। বিশেষ করে, চুক্তিতে এমন বিধান রাখা হয়েছে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা বাড়তি শুল্ক আরোপ করে, তাহলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ এই ধরণের বিধান মানতে নারাজ কারণ এটি দেশের স্বাধীন বাণিজ্য নীতির পরিপন্থী।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানিতে ছাড় দেবে, সেসব পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এই শর্ত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মোস্ট-ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফএন) নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দিচ্ছে না।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ দরকষাকষির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিন দফা খসড়া বিনিময় হয়েছে এবং চারটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ৮ জুলাই আরও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। দেশের স্বার্থ রক্ষা করতেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এবং দু’পক্ষের সম্মতিতে একটি সমঝোতা হবে।’
সূত্রের আরও দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের কঠিন শর্তাবলীর জন্যই এখনও কোনো দেশই এই ধরনের শুল্ক চুক্তি চূড়ান্ত করতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়া এই ইস্যুতে সর্বাধিক এগিয়ে থাকলেও, দুই সপ্তাহ আগে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের শর্তে তারা চুক্তি করবে না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে শুল্ক বিষয়ে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর পথে রয়েছে।
গত ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। এর ফলে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ হয়। যদিও ৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র এই পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করে। স্থগিতাদেশ আগামী ৮ জুলাই শেষ হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, আলোচনা অব্যাহত থাকার কারণে বাড়তি শুল্ক কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এবারের শুল্ক চুক্তি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হবে, যা রপ্তানি খাতের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। তাই দেশের স্বার্থ রক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির সঠিক মেলবন্ধন করতে দু’দেশের আলোচনার এই দফা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সর্বোচ্চ সচেতনতা ও কূটনৈতিক দক্ষতায় এ আলোচনায় অংশ নিচ্ছে, যাতে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব বজায় থাকে। দুই দেশের মধ্যে যৌথ স্বার্থের সমাধান নিশ্চিত করতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে নেওয়া হবে।
এই প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়ন দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আরও মজবুত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ