
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান ডিজিটাল যুগে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের একটি বড় অংশ ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং, যোগাযোগ, কেনাকাটা, সরকারি সেবা, এমনকি স্বাস্থ্যসেবা—সব কিছুই এখন অনলাইনের ওপর নির্ভরশীল। এই অনলাইন সুবিধার পেছনে আছে আমাদের অসংখ্য অ্যাকাউন্ট, আর এই অ্যাকাউন্টগুলোকে সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে পাসওয়ার্ড। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক ব্যবহারকারী এখনও এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করছেন যা হ্যাকারদের জন্য সহজ লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করার পরও, ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা, অলসতা এবং তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবের কারণে পাসওয়ার্ড হ্যাকিং-এর ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন পাঁচ ধরনের পাসওয়ার্ড চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো সবচেয়ে বেশি হ্যাক হয়। নিচে এই পাঁচটি দুর্বল পাসওয়ার্ড প্র্যাকটিস বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলো।
১. সাধারণ ও অনুমানযোগ্য পাসওয়ার্ড
সবচেয়ে বেশি হ্যাক হওয়া পাসওয়ার্ডের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সোজাসাপ্টা এবং অনুমানযোগ্য পাসওয়ার্ডগুলো। যেমন: 123456, password, qwerty, abc123, admin ইত্যাদি। এই পাসওয়ার্ডগুলো এতো সাধারণ যে হ্যাকাররা প্রথম দিকেই এগুলো ট্রাই করে থাকে। অনেকেই সহজে মনে রাখার জন্য বা সময় বাঁচাতে এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন, যা বাস্তবে তাদের অনলাইন নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডগুলোর মধ্যেই উপরোক্ত প্যাটার্নগুলোই ঘুরে ফিরে আসে। ফলে, যারা এগুলো ব্যবহার করেন, তারা প্রথম সারির ঝুঁকিতে থাকেন।
২. ব্যক্তিগত তথ্যনির্ভর পাসওয়ার্ড
বহু মানুষ নিজের নাম, সন্তানের নাম, জন্মতারিখ, প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় গানের নাম বা পোষা প্রাণীর নামের ভিত্তিতে পাসওয়ার্ড তৈরি করেন। উদাহরণস্বরূপ: rahim1990, tiger123, sumi2020, messi10 ইত্যাদি। এই পাসওয়ার্ডগুলো হয়তো ব্যবহারকারীর কাছে অর্থবহ এবং সহজে মনে রাখা যায়, কিন্তু হ্যাকারদের কাছেও এগুলো ভীষণভাবে অনুমানযোগ্য। কারণ এই ধরনের তথ্য অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, কমেন্ট, কিংবা অন্যান্য অনলাইন প্রোফাইলে খুঁজে পাওয়া যায়।
এমনকি সাইবার অপরাধীরা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এই তথ্য সংগ্রহ করে আপনার পাসওয়ার্ড অনুমান করার চেষ্টা করতে পারে। ফলে ব্যক্তিগত তথ্যভিত্তিক পাসওয়ার্ড নিরাপত্তাহীনতার এক বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
৩. একই পাসওয়ার্ড বারবার ব্যবহার
এটি একটি খুবই প্রচলিত ও মারাত্মক ভুল। অনেকেই সময় বাঁচাতে বা স্মরণ রাখতে সহজ হয় বলে একটি পাসওয়ার্ড সব অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করেন। যেমন, কেউ যদি তার ইমেইল, ফেসবুক, অনলাইন ব্যাংকিং এবং ক্লাউড স্টোরেজ অ্যাকাউন্টে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে একটি অ্যাকাউন্ট ফাঁস হলেই বাকি সব অ্যাকাউন্ট হ্যাকারের দখলে চলে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার হামলার অনেকগুলো ঘটনায় দেখা গেছে যে, ব্যবহারকারীর একটি অ্যাকাউন্ট ফাঁস হওয়ার পর হ্যাকার একই পাসওয়ার্ড দিয়ে অন্যান্য ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে।
৪. অনেক পুরাতন ও অপরিবর্তিত পাসওয়ার্ড
অনেক ব্যবহারকারী বছরের পর বছর ধরে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন। তারা হয়তো একবার একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ড সেট করেছেন এবং ভাবছেন সেটি নিরাপদই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বহু বছর আগে ডেটা লিক হওয়া পাসওয়ার্ডের ডেটাবেস এখন হ্যাকারদের কাছে সহজলভ্য। এ ধরনের ‘ডাম্পড ডেটাবেস’ থেকে হ্যাকাররা পুরাতন পাসওয়ার্ড নিয়ে নতুন করে চেষ্টা চালায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিয়মিত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন না করলে, হ্যাকাররা যেকোনো সময় সেই পুরাতন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে আপনার নতুন অ্যাকাউন্টেও ঢুকে যেতে পারে।
৫. ছোট ও সরল পাসওয়ার্ড
হ্যাকাররা আজকাল ব্রুট ফোর্স (brute-force) নামক পদ্ধতি ব্যবহার করে সেকেন্ডের মধ্যে লক্ষ লক্ষ পাসওয়ার্ড চেষ্টা করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে ছোট এবং খুব সাধারণ পাসওয়ার্ডগুলো প্রথমেই ভেঙে যায়। যেমন: 123, abcd, 987654, aaaaaa—এই ধরনের পাসওয়ার্ডগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষিত প্যাটার্নে চলে আসে।
বিশেষ করে যারা শুধুমাত্র সংখ্যা বা শুধুমাত্র ছোট হাতের অক্ষর ব্যবহার করেন, তাদের পাসওয়ার্ড হ্যাকিং-এর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এর ফলে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, আর্থিক লেনদেন, এমনকি পরিচয়ও চুরি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
শক্তিশালী পাসওয়ার্ড গঠন করুন
একটি আদর্শ পাসওয়ার্ড কমপক্ষে ১২-১৬ অক্ষরের হওয়া উচিত, যেখানে থাকতে হবে ছোট হাতের অক্ষর, বড় হাতের অক্ষর, সংখ্যা ও বিশেষ চিহ্নের সংমিশ্রণ। উদাহরণস্বরূপ: B7r#kM2!sQ8^vX
প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
সব অ্যাকাউন্টে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা এক ধরনের ‘ডোমিনো রিস্ক’ তৈরি করে। একটি অ্যাকাউন্ট ফাঁস হলে অন্যগুলোও পড়ে যাবে। তাই প্রতিটি অ্যাকাউন্টে আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা উচিত।
পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করুন
অনেকগুলো জটিল পাসওয়ার্ড মনে রাখা কঠিন। এজন্য ব্যবহার করতে পারেন একটি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার অ্যাপ, যেমন Bitwarden, 1Password, বা LastPass। এগুলো আপনার সব পাসওয়ার্ড এনক্রিপ্ট করে সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষণ করবে।
টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA) চালু করুন
শুধু পাসওয়ার্ড নয়, দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তা হিসেবে 2FA ব্যবহারের অভ্যাস গড়ুন। এতে আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকতে হলে পাসওয়ার্ড ছাড়াও OTP বা Authenticator Code লাগবে, যা হ্যাকারদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নিয়মিত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন
কমপক্ষে প্রতি ৩ মাসে আপনার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাউন্টগুলোর পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন। একই সঙ্গে, আগের পাসওয়ার্ডের সঙ্গে খুব বেশি মিল যেন না থাকে, সেটাও নিশ্চিত করুন।
পাসওয়ার্ড হলো আপনার ডিজিটাল জীবনের প্রথম এবং প্রধান নিরাপত্তা স্তর। এটি যত দুর্বল হবে, আপনার তথ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে তত সহজে। তাই শুধু সহজে মনে রাখার জন্য নয়, বরং নিরাপদ থাকার জন্য বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাসওয়ার্ড গঠন এবং ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে।
আপনার পাসওয়ার্ড কি এই পাঁচ ধরনের মধ্যে পড়ে? যদি পড়ে, এখনই সময় সেটি বদলে নেওয়ার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ