
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর চলমান আগ্রাসনে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন তিন শতাধিক ফিলিস্তিনি। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা চললেও বাস্তবে গাজা যেন রক্তাক্ত মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না ইসরাইলি হামলা থেকে।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত দুই দিনে গাজা জুড়ে ইসরাইলি বাহিনী অন্তত ২৬টি বড় ধরনের গণহত্যা চালিয়েছে। এর মধ্যে শুধু বৃহস্পতিবারেই নিহত হয়েছে ৭৩ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে ৩৩ জন নিহত হয়েছেন বিতর্কিত “গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন” বা জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ সংগ্রহ কেন্দ্রের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ইসরাইলি বাহিনী ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো ছাড়াও বারবার হামলা চালিয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে নারী ও শিশুদের বসবাস বেশি। বৃহস্পতিবারের হামলার সবচেয়ে ভয়াবহ দুটি occurred আল-মাওয়াসি ও মোস্তাফা হাফেজ স্কুলে। আল-মাওয়াসির একটি শরণার্থী শিবিরে বাস্তুচ্যুত মানুষের অস্থায়ী তাবুতে চালানো এক বর্বর বোমা হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, মোস্তাফা হাফেজ স্কুল, যা বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেখানেও হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনারা।
এই মুহূর্তে গাজা এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ—কোনো কিছুই পর্যাপ্ত নেই। এই পরিস্থিতিতে ত্রাণ গ্রহণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ওপরও হামলা চলছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজজুম জানান, দেইর আল-বালাহ শহরে জিএইচএফ পরিচালিত খাদ্য সহায়তা কেন্দ্রে গুলি চালানো হয়েছে।
এই সহায়তা কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে মার্কিন নিরাপত্তাকর্মীরা, যাদের আচরণ নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানায়, মার্কিন ঠিকাদারি সংস্থার অধীনে নিযুক্ত এসব নিরাপত্তাকর্মীরা গাজায় কার্যত ‘প্রাইভেট মিলিশিয়া’ হিসেবে কাজ করছে। তারা শুধু অস্ত্রে সজ্জিতই নয়, তাদেরকে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছামতো গুলি চালানোর স্বাধীনতা।
এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুইজন মার্কিন ঠিকাদার জানান, এই নিরাপত্তাকর্মীদের অধিকাংশই অযোগ্য এবং তাদের পেছনে নেই কোনো পেশাদার প্রশিক্ষণ কিংবা নৈতিক জবাবদিহিতা। এক ঠিকাদার বলেন, “ওদের হাতে শুধু অস্ত্রই নয়, দেওয়া হয়েছে আদেশহীন গুলির অধিকার।”
ইতোমধ্যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই সহায়তা কেন্দ্রগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত মঙ্গলবার অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ১৩০টির বেশি সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে জিএইচএফ বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তারা অভিযোগ করেছে, ‘ক্ষুধা’কে অস্ত্র বানিয়ে ফিলিস্তিনিদের দমন করছে ইসরাইল এবং তাদের মদদপুষ্ট সংগঠনগুলো।
বিবৃতিতে বলা হয়, “জিএইচএফ ও তাদের সঙ্গে জড়িত বাহিনীগুলো নিয়মিতভাবে খাদ্য নিতে আসা বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাচ্ছে। এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে, আহত হয়েছেন প্রায় চার হাজার।”
একইসঙ্গে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বিশ্ব সংস্থাটি বলেছে, গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর নিরাপদ পথ নিশ্চিত না হলে সহসা দুর্ভিক্ষ ঠেকানো সম্ভব হবে না।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সামগ্রিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইলের চালানো হামলায় গাজায় নিহত হয়েছেন ৫৬ হাজার ৬৪৭ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৪ হাজার ১০৫ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু, নারী এবং নিরীহ বেসামরিক মানুষ।
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিরতির দাবি বাড়লেও নেতানিয়াহুর সরকার তা আমলে নিচ্ছে না বলেই বিশ্লেষকদের মত। ইসরাইল সরকার বারবার বলছে, তারা হামাসের ‘শেষ চিহ্ন’ পর্যন্ত ধ্বংস না করে থামবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এই ‘চিহ্ন’ মুছতে গিয়ে ইসরাইল কি পুরো এক জাতিকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে?
গাজা উপত্যকা আজ এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি নিশ্বাসের জন্য প্রয়োজন সাহস, প্রতিটি খাদ্য সংগ্রহের প্রয়াসে প্রয়োজন জীবন বাজি রাখা। ইসরাইলের হাতে যদি খাদ্যও হয়ে যায় ‘অস্ত্র’, তবে মানবতা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে—এই প্রশ্ন আজ গোটা বিশ্বের সামনে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ