
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ক্রমেই কমছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিতে গিয়ে সরকারের নেওয়া কঠোর শর্তের কারণে সঞ্চয়পত্রের সুদহার ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়েছে। এর ফলে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির প্রভাব এবং কম সুদে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে আকর্ষণের অভাবে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, পেনশনার এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠী তাদের সঞ্চয়পত্র ভাঙার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং অবসরপ্রাপ্তদের জন্য একটি নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তবে বর্তমানে সরকারের উদ্যোগে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে আনার কারণে এই মাধ্যমটি থেকে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। গত তিন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে; ৩৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য থেকে বর্তমান সময়ে তা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং সংকোচনমূলক বাজেট নীতির মধ্যে সঞ্চয়পত্রে সুদের এই হ্রাস বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, সরকার সংকোচনমূলক বাজেট এবং কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করলেও সঞ্চয়পত্রের সুদ কমালে বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে ব্যাংকের উচ্চ সুদে আগ্রহী হবে। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ সংগ্রহ কমে গিয়ে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হ্রাসের কারণ হবে।
সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বড় ধাক্কা। অনেকেই সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত আয়েই পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় চালান। এই সংকটে তাদের ওপর প্রভাব পড়বে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, সরকার স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী জানান, “আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ কমাতে হচ্ছে। এর ফলে বয়স্ক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আর্থিক সংকটে পড়ে তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদ প্রদান করায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে আসবে। অতীতে মানুষ প্রাইজবন্ডে বিনিয়োগ করতেন, যা এখন আর আকর্ষণীয় নয়।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ প্রদান করলে আর্থিক ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বন্ড মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুদ বেশি থাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড বাজারে বন্ড ছাড়তে আগ্রহী হয় না, যা আর্থিক খাতের সমগ্র উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সমস্যার মোকাবিলায় নিচ্ছে পদক্ষেপ।
তাদের মতে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সরকার ভিন্নভাবে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। পেনশনারদের জন্য পেনশনের পরিমাণ বাড়ানো এই ব্যবস্থার একটি অংশ হতে পারে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফ থেকে প্রথম কিস্তি পেয়ে বাংলাদেশ সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আগে যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা লাফিয়ে কমে ১৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও কমিয়ে আনা হয় ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে তা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণ সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া যাবে না। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহার অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের সুদ নির্ধারণ করা হবে, যা বাড়লেও কমলেও তার সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হবে।
সঞ্চয়পত্র সাধারণ মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা উপকরণ। কিন্তু সুদহার কমে যাওয়া এবং বিক্রির লক্ষ্য কমানোর ফলে এক বড় অংশ মানুষ অর্থনৈতিক দুর্দশায় পতিত হচ্ছে। সরকারি একটি ঋণ যন্ত্র হিসেবে সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিকল্প পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি বিশেষজ্ঞরা করছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, যদিও সরকার সঞ্চয়পত্রকে সামাজিক নিরাপত্তার একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে, তবে আইএমএফের চাপের কারণে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর উচ্চ সুদ প্রদান করায় অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ছে। এতে সামাজিক নিরাপত্তার কাজ করলেও এই ব্যবস্থার টেকসইতা প্রশ্নবিদ্ধ।
সঞ্চয়পত্রে সুদের কমিয়ে আনা এবং বিক্রির লক্ষ্য সংকুচিত করার ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্রমেই এ ক্ষেত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এই পরিবর্তন বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং অবসরপ্রাপ্তদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। সরকারের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সুরক্ষিত রেখে সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাকে টেকসই করা যায়। আর এই ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ