
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে এক বড় সংকটের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাল্টা শুল্ক আরোপ (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) এবং দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনায় ধীরগতির কারণে দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মক অনিশ্চয়তায় আছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে দেশের তৈরি পোশাক খাত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ভয়াবহ দুর্বলতায় পতিত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সাড়ে ১০ লাখ পোশাক শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য এক ভীতিকর সংকেত।
গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির অস্থিতিশীলতা ও বাণিজ্য আলোচনায় সাফল্য না আসায় রপ্তানিকারকরা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে দেশের রপ্তানিকারকদের ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিয়ে মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানি করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কারখানাগুলোর প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ধরনের বিপর্যয় কাজ হারানোর আশঙ্কা বাড়িয়েছে সাড়ে ১০ লাখ পোশাক শ্রমিকের মধ্যে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৮৪০ কোটি ডলার, যার মধ্যে প্রায় ৭৩৪ কোটি ডলার ছিল তৈরি পোশাক। এই বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োগকৃত শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বিপুল ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে দেশের পোশাক খাতে মারাত্মক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি দর-কষাকষির জন্য লবিইস্ট নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার। এছাড়া সরকারের আলোচনার বিষয়গুলো শুধু শুল্ক সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক রাজনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।”
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক দিকেই সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।”
অন্যদিকে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ট্যাড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, “ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ভারত ইত্যাদির তুলনায় যদি বাংলাদেশের শুল্ক হার বেশি হয়, তাহলে মার্কিন বাজার ধীরে ধীরে হারাতে হবে। তবে দর-কষাকষির মাধ্যমে শুল্ক কমিয়ে আনলে এই বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।”
শ্রমিকদের ভাগ্যে আঁধার: এক দশমিক পাঁচ লাখ কারখানা শ্রমিক অনিশ্চয়তার মুখে
দেশে ছোট ও মাঝারি আকারের প্রায় ১,১০০টির বেশি পোশাক কারখানায় সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। ছোট কারখানাগুলো বছরে ৫ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পণ্য রপ্তানি করে এবং গড়ে ৭০০ জন শ্রমিক রয়েছে। মাঝারি আকারের কারখানাগুলো বছরে ৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে এবং গড়ে ১,০০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এসব কারখানার বড় অংশে নারীরা কর্মরত রয়েছেন।
শুল্কের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে না পারায় এসব কারখানা ক্রয়াদেশ হারাতে পারে এবং সম্ভাব্যভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক কাজ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে দেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা হারানো ছাড়াও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়বে।
সরকার সংকট মোকাবেলায় বেশ কয়েকটি কৌশল গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘জিটুজি’ (সরকার থেকে সরকার) চুক্তির মাধ্যমে প্রায় তিন লাখ টন গম আমদানি। যদিও এর মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হতে পারে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমানের আমদানি, তুলা, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক সমন্বয় করার বিষয় সরকারের বিবেচনায় রয়েছে।
সরকার আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফার বৈঠকে এই সংকটের জন্য কার্যকর সমাধান আসবে। তবে বাণিজ্য ও শুল্ক বিষয়ক আলোচনায় রাজনৈতিক পদক্ষেপের গুরুত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক।
বাণিজ্য বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পোশাক খাতের এই অনিশ্চয়তা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বড় অংশে প্রভাব ফেলবে। কর্মসংস্থান সংকট বাড়ার পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়বে। এতে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “দেশীয় শিল্পের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কার্যকর আলোচনা প্রয়োজন। পাশাপাশি, বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তন ও নীতি মোতাবেক আমাদের প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও বাণিজ্য অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়েছে। দেশের ১০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাওয়ায় সরকার, বাণিজ্যিক সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে একজোট হয়ে এই সংকট মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দক্ষতা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ