
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একের পর এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাওয়ায় এবার নতুন করে আরও পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এনবিআরের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, রাজস্ব ফাঁকি, ঘুষ ও অসদুপায় অবলম্বনের মতো গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ধাপে ধাপে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) দুদকের জনসংযোগ দপ্তরের সহকারী পরিচালক তানজির আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, নতুন করে যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা হলেন- কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (পূর্ব) এর কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, রাজশাহী কর অঞ্চল, সার্কেল-৭ এর উপকর কমিশনার মো. মামুন মিয়া (বর্তমানে যুগ্ম কর কমিশনার), আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা ও কর অঞ্চল-২, ঢাকার কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। এর মধ্যে সেহেলা সিদ্দিকা এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের মহাসচিব এবং লোকমান আহমেদ সক্রিয় সদস্য।
এর আগে দুদক দুই ধাপে মোট ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল। ফলে তিন দফায় মোট ১৬ জন এনবিআর কর্মকর্তা এখন দুদকের নজরদারিতে রয়েছেন।
দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে কর ফাঁকির সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এসব কর্মকর্তা করদাতাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে হিসাব কম দেখিয়ে রাজস্ব আদায়ে সহায়তা করেছেন। আবার, যেসব করদাতা ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা মামলার মাধ্যমে হয়রানি করা হয়েছে। এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে করদাতারাও ভীত ও বিব্রত অবস্থার মধ্যে পড়ছেন।
দুদক মনে করছে, এসব কর্মকর্তার কারসাজির কারণে প্রতিবছর সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক অভিযোগ করেছেন, এনবিআরের একটি চক্র নানাভাবে ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করে, আবার যারা ঘুষ দেয় না তাদের ফাঁকি দেওয়ার মামলা দিয়ে হয়রানি করে।
দুদকের অনুসন্ধানে যেসব কর্মকর্তার নাম এসেছে, তাদের অনেকেই এনবিআরের চলমান আন্দোলন, কলম বিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ও সর্বশেষ দুই দিনের 'কমপ্লিট শাটডাউন'-এ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে জানা গেছে। এনবিআরের কিছু কর্মকর্তা গত সপ্তাহ থেকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্দোলন শুরু করেন। তারা অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্ত, স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এনবিআরের কাজের পরিবেশ নষ্ট করছে।
এই প্রেক্ষাপটে রোববার দুদক প্রথমে ছয়জন কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর ঘোষণা দেয়। এরপর সোমবার থেকে আন্দোলনকারীরা কর্মস্থলে ফিরে গেলেও, পরদিনই আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয় সংস্থাটি।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করছেন, আন্দোলনের কারণে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করা হচ্ছে। তবে দুদক তাদের অবস্থানে অনড়। সংস্থাটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, "আমাদের অনুসন্ধান তথ্যনির্ভর। কারও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা কিংবা মত প্রকাশ করা অনুসন্ধানের কারণ নয়। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ এসেছে, সেই ভিত্তিতেই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।"
দুদক সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট পাঁচ কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণ, সম্পদের উৎস, পদোন্নতি ও পোস্টিং সংক্রান্ত তথ্য এবং কর্মজীবনের আয়ের হিসাব নিয়ে বিশদ অনুসন্ধান চলছে। প্রয়োজনে তাদের সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের কয়েকজন অভিজ্ঞ উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক।
একইসঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন, ব্যবসায়িক অংশীদার কিংবা পারিবারিক সদস্যদের ব্যাংক হিসাব, কোম্পানি নিবন্ধন বা সম্পত্তি অধিগ্রহণের তথ্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কিছু কর্মকর্তার বিপুল অপ্রদর্শিত সম্পদের তথ্য ইতোমধ্যে উদঘাটন হয়েছে, যেগুলোর কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যাচ্ছে না।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনুসন্ধান শেষ হলে প্রাথমিক অনুসন্ধান রিপোর্ট কমিশনের বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে সন্তোষজনক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এনবিআরের অভ্যন্তরে এ ধরনের ব্যাপক দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হওয়ায় সরকারি রাজস্ব আদায়কারীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে কর্মীদের মনোবল ও স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও আগামী বাজেট বাস্তবায়নে প্রভাব পড়তে পারে।
অন্যদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনবিআরের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং রাজস্ব ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এই অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত ‘সুবিধাভোগী চক্র’ বছরের পর বছর ধরে রাজস্ব ব্যবস্থাকে জিম্মি করে রেখেছে, যেটি ভাঙতে হলে উচ্চপর্যায়ে শক্ত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
দুদকের একজন সাবেক কমিশনার বলেন, “রাজস্ব খাতে দুর্নীতি বন্ধ না হলে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে পড়বে। বড় বড় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ালে সাধারণ করদাতাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তাই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বারবার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা এবং দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর জনআস্থার বড় একটি পরীক্ষা। তিন ধাপে ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এই বার্তা দেয় যে, সরকারি কর্মকর্তারাও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন।
তবে এই অনুসন্ধান যেন রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা প্রশাসনিক সংকটের ইন্ধনে পরিচালিত না হয়, সে বিষয়েও সচেতন থাকা জরুরি। একইসঙ্গে দরকার এনবিআরের আভ্যন্তরীণ সংস্কার, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং করদাতাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।
রাজস্ব ব্যবস্থা যদি দুর্নীতিমুক্ত হয়, তবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে—এমনটাই প্রত্যাশা দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।
বাংলাবার্তা/এসজে