
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের আমানত পরিবর্তন দেখা গেছে। গত বছর ১০টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে মোট ২৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার আমানত সরিয়ে নিয়ে যান আমানতকারীরা। তবে এই টাকার বেশিরভাগই অন্য ভালো অবস্থার ব্যাংকগুলোতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে ভালো ব্যাংকগুলোর আমানত উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, কখনো কখনো ৩০ শতাংশেরও বেশি।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় আমানতকারীরা সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ বা সমস্যা থাকায় পরিচিত ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। ২০২৪ সালেও এই প্রবণতা দেখা গেছে। কিছু ব্যাংক যেমন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সহ একাধিক ব্যাংক তাদের আমানত উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাসের মুখে পড়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ২০২৩ সালের ৩৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা থেকে ২০২৪ সালে ১৫ শতাংশ কমে ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংক: ৪২ হাজার ৬১০ কোটি টাকা থেকে কমে ৩৬ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক: আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ কমে চার হাজার ২৬৪ কোটি টাকা হ্রাস।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান জানান, গত জুলাইয়ে ব্যাংকটির সাথে বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে টাকা তুলে নেওয়ার ধারা শুরু হয়। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমে যাওয়া আমানত চলতি বছরের জুন পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। নতুন বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা নিয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নত করার চেষ্টা চলছে।
দেশের সবচেয়ে লাভজনক বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের আমানতও ২০২৪ সালে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। ব্যাংকটির ভাষ্য, ডলার সংকট সত্ত্বেও তারা বিমান শিল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে ঋণ প্রদান করেছে, যা সাময়িকভাবে আমানতের পরিমাণে প্রভাব ফেলেছে। এবি ব্যাংক: ২০২৩ সালে আমানত বৃদ্ধি হলেও ২০২৪ সালে প্রায় ১০ শতাংশ কমে ৩২ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংক: আমানত কমেছে ৮ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, জনতা ব্যাংক: খেলাপি ঋণ বেশি থাকায় আমানত কমেছে, যা তাদের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
অপরদিকে, অনেক ভালো পরিচালিত ব্যাংক নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের আমানত উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক: ৩২ শতাংশ বেড়ে ৭৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংক: ৩১ শতাংশ বেড়ে ৫১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক: ২৭ শতাংশ বেড়ে ৩১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আরো কিছু ব্যাংক যেমন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক ২০ শতাংশের বেশি আমানত প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার শেয়ারদর ১৫ শতাংশের উপরে বেড়েছে।
নতুন গঠিত কিছু ব্যাংকও ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। মিডল্যান্ড ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংক গত বছর আমানত বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।
একজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা জাকির হোসেন গতবছর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক থেকে তার সঞ্চিত টাকা তুলে ভালো একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করেন। তার মতো হাজার হাজার আমানতকারী একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা ভালো ব্যাংকগুলোর আমানত বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, ভালো ব্যাংকগুলোতে আমানতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মূলত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে আনার কারণ। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায়। গ্রাহকরা শুধু সুদের হার দেখে নয়, ব্যাংকের অবস্থান ও স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের টাকা নিরাপদ ব্যাংকে সরিয়েছেন।”
বিশেষ করে দেশের ব্যাংকগুলো তাদের আয়ের বড় অংশ ট্রেজারি বন্ড ও সরকারি বিলের সুদ থেকে অর্জন করে থাকে। এটি তাদের স্থিতিশীলতা ও লাভজনকতার একটি বড় ফ্যাক্টর। ভালো ব্যাংকগুলো এই সুদ থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ পাচ্ছে, যা তাদের কার্যক্রম ও গ্রাহক আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জেড এম বাবর খান বলেন, ২০২৩ সালে তাদের ব্যাংকের আমানত ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বেড়েছিল। তবে ২০২৪ সালে গুজব ও মার্জারের সম্ভাবনার কারণে অনেক আমানতকারী টাকা তুলে নিয়েছিলেন। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট অবস্থানের কারণে আস্থা ফেরে। তিনি বলেন, “আমাদের গ্রাহক ভিত্তি শক্তিশালী এবং গ্রাহকরা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আমরা সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার নতুন আমানত পেয়েছি।”
২০২৪ সালের ব্যাংকিং খাতের ছবি থেকে স্পষ্ট, দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও বিতর্কিত ব্যাংকগুলো থেকে টাকা সরিয়ে ভালো পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে স্থানান্তর হয়েছে। এর ফলে ভালো ব্যাংকগুলোর আমানত অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, আবার কিছু ব্যাংকের আমানত উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিতে ফেরার জন্য ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও গ্রাহকদের আস্থার পুনরুদ্ধার অপরিহার্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন, স্বচ্ছতা ও ভালো ব্যবস্থাপনার ওপর এখন যে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, সেটাই আগামী দিনে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ