
ছবি: সংগৃহীত
ওয়ানডে ক্রিকেটে এমন ধস আগেও দেখা গেছে, তবে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে বুধবার যে দৃশ্য দেখলো ক্রিকেটবিশ্ব, তা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন এক দুঃখগাথা হয়ে থাকবে।
২৪৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে একসময় ১ উইকেটে ১০০ রান করে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে ২৫ বলের ব্যবধানে মাত্র ৫ রান যোগ করেই হারিয়ে বসে ৭ উইকেট! ওয়ানডে ইতিহাসে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম উইকেট পর্যন্ত এতো কম রানে হারানোর নজির নেই আর কোনো দলের।
বাংলাদেশের এই দুর্দশার আগে সবচেয়ে কম রানে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম উইকেট হারানোর রেকর্ড ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ২০২০ সালে নেপালের বিপক্ষে মাত্র ৮ রানে ছয় উইকেট হারিয়েছিল তারা (২৩ থেকে ৩১ রান)। এবার সেই রেকর্ডও পেছনে ফেলে দিলো টাইগাররা—১০০ থেকে ১০৫ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে।
এই ধসের পেছনে মূল অবদান শ্রীলংকার স্পিন জাদুকর ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা এবং অলরাউন্ডার কামিন্দু মেন্ডিসের। একেবারে মাঝের ওভারে এসে তারা ঢালাও কেটে ফেললেন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনের মূল শিকড়। এর আগে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করে শ্রীলংকা। শুরুটা ছিল হতাশাজনক। ৬.১ ওভারে দলীয় স্কোর যখন ২৯, ততক্ষণে তিন উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় স্বাগতিকরা।
ওপেনার পাথুম নিশাঙ্কা ৩ রানে আউট হন তানজিম হাসান সাকিবের বলে। পঞ্চম ওভারের তৃতীয় বলে নিশান মাদুশকা ও সপ্তম ওভারের প্রথম বলে কামিন্দু মেন্ডিসকে ফেরান তাসকিন আহমেদ। তবে তখন দৃঢ়তা দেখান অধিনায়ক চারিথ আসালাঙ্কা। চতুর্থ উইকেটে কুশাল মেন্ডিসের সঙ্গে গড়েন ৬০ রানের জুটি। কুশাল করেন ৪৩ বলে ৪৫ রান। এরপর জেনিথ লিয়ানাগে-র সঙ্গে আরও ৬৪ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়েন আসালাঙ্কা। তবে আসল কাজটি করেন ইনিংসের মাঝামাঝি ও শেষ ভাগে। ষষ্ঠ উইকেটে মিলান রত্নায়েকে (২২) এবং সপ্তম উইকেটে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা (২২)-র সঙ্গে ৩৯ ও ৩৪ রানের দুটি কার্যকর জুটি গড়ে দলকে পৌঁছে দেন ২৪৪ রানে।
অধিনায়ক আসালাঙ্কার ব্যাট থেকে আসে ১০৬ রান, ১২৩ বলে ৬টি চার ও ৪টি ছক্কায় সাজানো এক চমৎকার ইনিংস। এটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পঞ্চম শতক, এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয়। বাংলাদেশের পক্ষে বল হাতে উজ্জ্বল ছিলেন তাসকিন আহমেদ এবং তানজিম হাসান সাকিব। তাসকিন ৮.৩ ওভারে ৪৭ রান দিয়ে নেন ৪টি উইকেট। তানজিম ৮ ওভারে ৪৬ রানে তুলে নেন ৩টি উইকেট। প্রথম ১০ ওভারেই লংকান ব্যাটিং লাইনকে ভেঙে দিয়েছিল বাংলাদেশের পেস বোলিং জুটি।
বাংলাদেশের ইনিংস শুরু হয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। ওপেনাররা稳ভাবে খেলে দলীয় ৫০ রানে পৌঁছে যান। এরপর তামিম আউট হলেও, দ্বিতীয় উইকেটে লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান জুটি গড়েন ৫০ রানের আরও একটি জুটি।
সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল, তখনই থমকে যায় সব পরিকল্পনা। স্কোর ১০০ রান পেরোতেই প্রথম শিকার করেন হাসারাঙ্গা। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের ভরাডুবি। কামিন্দু ও হাসারাঙ্গার ঘূর্ণিজালে ফেঁসে গিয়ে ২৫ বলেই উইকেট পড়তে থাকে ১টির পর একটি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যায় ১০৭ রানে। ২৪৫ রানের লক্ষ্য ছোঁয়া তো দূরে থাক, দেড়শো পেরোতে না পারাই হয়ে গেল নতুন লজ্জার ইতিহাস।
বিশ্লেষকদের মতে, স্পিন-সহায়ক পিচে বাংলাদেশের ব্যাটাররা প্রয়োজনীয় ধৈর্য ও প্রয়োগ দেখাতে পারেননি। মিরপুরে খেলা যতটা পরিচিত, কলম্বোর কন্ডিশনে থিতু হতে তেমন প্রস্তুতি ছিল না। বিপদের সময় দায়িত্ব নিতে পারেননি সিনিয়র ব্যাটাররা। মিডল অর্ডারে ফর্মহীনতা আর ব্যাটিং অর্ডারের ধসই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছে।
ক্রিকেট শুধুই রান, বল আর উইকেটের খেলা নয়; এটি মানসিক দৃঢ়তারও ময়দান। কলম্বোর প্রেমাদাসায় বুধবার রাতটি তাই হয়ে থাকল বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসে বড় এক আঘাতের রাত।
এক ম্যাচে এমন ব্যাটিং ধস স্বাভাবিক নয়, বিশেষ করে একসময় যখন জয় হাতছোঁয়া দূরত্বে ছিল। নতুন রেকর্ডের খাতায় নাম লেখানো গেল বটে, তবে তা গর্বের নয়—তীব্র হতাশা আর বিশ্লেষণের ডাক রেখে গেলো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে।
এখন সময় শিক্ষা নেওয়ার, কারণ বিশ্বকাপের আগেই বারবার এমন আত্মসমর্পণ দল ও দেশের জন্য এক অশনি সঙ্কেত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ