
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। সরকার গত কয়েকদিনে এনবিআরের তিন সদস্য ও এক কমিশনারকে অবসর দিয়েছে এবং এক কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এনবিআরের অন্য বেশ কয়েকজন সদস্য ও কমিশনারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নেমেছে। এই সব পদক্ষেপের ফলে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী নেতাদেরও বিব্রত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে চারজনের চাকরির অবসরের জন্য পৃথক আদেশ জারি করা হয়েছে। অবসরে পাঠানো সদস্যরা হলেন—কর্মকর্তা কর বিভাগের সদস্য আলমগীর হোসেন, শুল্কনীতি ও আইসিটি বিভাগের সদস্য হোসেন আহমদ, মূসক নীতি বিভাগের সদস্য আবদুর রউফ এবং কমিশনার মোহম্মদ শব্বির আহমেদ। তাদের চাকুরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকার জনস্বার্থে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ ধারায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা বিধি অনুযায়ী অবসর সুবিধা পাবেন।
এদিকে, মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে ২৮ ও ২৯ জুন বন্দর বন্ধ রাখার কারণে, যা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করেছে ও রাজস্বে ক্ষতি করেছে। যদিও বরখাস্তকালে তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোশ ভাতা পাবেন।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, এনবিআরের শাটডাউনের কারণে দেশের বন্দর কার্যক্রম বন্ধ হওয়া নজিরবিহীন ঘটনা ছিল, যা দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ সময় ব্যবসায়ীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়েছিলেন। সরকার তখন আশ্বাস দিয়েছিল, আন্দোলন প্রত্যাহারের পর কোনো কর্মকর্তার চাকরি যাবে না। সেই আশ্বাসেই আন্দোলন প্রত্যাহার করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখন সরকারের এ অবস্থানে ব্যবসায়ীরা বিব্রত বোধ করছেন।
আনোয়ার উল আলম আরও বলেন, “যদি কারো বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, সরকার পরে ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু যখন শর্তহীন আন্দোলন প্রত্যাহার হয়েছে, তখন তাদের সম্মান রক্ষায় সরকারকেও ভাবতে হবে।”
এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করার পর থেকে গত ১২ মে থেকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন। তারা বিলুপ্তি রোধসহ কিছু দাবি তুলেছিলেন। এরপর ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশ সংশোধনের আশ্বাস দিলে প্রথম দফায় আন্দোলন প্রত্যাহার হয়। কিন্তু ২২ জুন থেকে চেয়ারম্যান অপসারণের দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়। ২৮ ও ২৯ জুন বন্দরগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এবং ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় ২৯ জুন রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার হয় এবং পরদিন থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগ দেন। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সকলকে ভুলে কাজ করার আহ্বান জানান। তবে এর পর থেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রশাসনিক ও তদন্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
২৯ জুন এনবিআরের নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, ঢাকা কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর অতিরিক্ত কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু এবং বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খানসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগে দুদক তদন্ত শুরু করে।
এরপর গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, সদস্য লুতফুল আজীম, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, কর অঞ্চল-১৬-এর উপকরকমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার তারেক হাছানের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঐক্য পরিষদের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, সরকার ও ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন, কিন্তু এখন এনবিআরের উচ্চ কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে যায়। অনেকেই বাধ্য হয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারা সরকারকে পুনরায় সৎ ও মানবিক অবস্থানে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “বন্দর বন্ধ করে দেশের অর্থনীতিকে জিম্মি করে এমন আন্দোলন সমর্থনযোগ্য নয়। ব্যবসায়ীরা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন, তখন সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে ভুল করলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল হবেন। এখন এভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এতে কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের ভাবা উচিত।”
সরকার এনবিআরের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করায় অফিসের পরিবেশ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। দুদকের তদন্ত, অবসর, বরখাস্তের মতো পদক্ষেপগুলোতে কর্মীরা আতঙ্কিত এবং আন্দোলনে ফেরার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা সরকারের সঙ্গে নিজেদের মধ্যস্থতার মধ্যেই পড়ে বিব্রত। তারা আশা করেন, সরকারের উচিত হবে পরিস্থিতির সংবেদনশীলতা বুঝে সবাইকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া।
এনবিআর-এর চলমান সংকট দেশের কর ব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্যের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সমন্বয় ও স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত এই অবস্থা আরও অব্যাহত থাকতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছে বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এসজে