
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর সংস্কার ও নেতৃত্ব পরিবর্তন ঘিরে চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে সরকারের একের পর এক কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। এবার আরও চার জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা—তিনজন সদস্য এবং একজন কমিশনার—কে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
বুধবার (২ জুলাই) বিকেলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে পৃথক চারটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এই আদেশ কার্যকর করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংগঠিত হয়ে যেসব কর্মকর্তারা সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের একটি বড় অংশই এখন একে একে প্রশাসনিক শাস্তির মুখে পড়ছেন।
সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী, যাদের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, সরকার জনস্বার্থে তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারে। এই ধারার প্রয়োগেই বুধবার অবসর দেওয়া হয়— হোসেন আহমদ, এনবিআরের সদস্য (শুল্ক নীতি ও আইসিটি), মো. আলমগীর হোসেন, সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন), ড. মো. আব্দুর রউফ, সদস্য (ভ্যাট নীতি) এবং মো. শব্বির আহমদ, কর কমিশনার (চলতি দায়িত্ব; মূল পদে অতিরিক্ত কর কমিশনার)।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এ চার কর্মকর্তা তাদের চাকরির মেয়াদ অনুযায়ী নিয়মিত অবসরজনিত সব সুবিধা পাবেন। তবে বাস্তব প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ‘দৃশ্যত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।
গত মে মাসে সরকার হঠাৎ করে এনবিআর বিলুপ্ত করে নতুন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করে, যার মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে ফেলে দুটি নতুন সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামেন, যার নেতৃত্ব দেয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’।
প্রথমদিকে আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল মধ্য ও নিচতলার কর্মকর্তাদের হাতে, কিন্তু জুনের মাঝামাঝি থেকে এনবিআরের সদস্য পর্যায়ের কর্মকর্তারাও সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হন। সেসময় ড. আব্দুর রউফ, হোসেন আহমদ এবং আলমগীর হোসেনকে গণশুনানিতে দেখা যায়। তাঁরা নানান সেমিনার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের ‘একতরফা সিদ্ধান্ত’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
কমিশনার শব্বির আহমদ সরাসরি এনবিআরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মিডিয়া ও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন, আন্তর্জাতিক উদাহরণ তুলে ধরেন এবং রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও নীতিগত স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। ফলে তাঁকেও অবশেষে একই ভাগ্য বরণ করতে হলো।
এর আগের দিন, গত মঙ্গলবার, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি ও রাজস্ব ক্ষতির কারণ হওয়া।
অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে এনবিআরের ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে, যাদের মধ্যে দুইজন বর্তমান সদস্যও রয়েছেন। এদের একজনকে এবার অবসরে পাঠানো হয়েছে।
তাছাড়া, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদারকেও দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। আন্দোলনের সামনের সারির এই নেতার বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এ সিদ্ধান্ত ‘জনস্বার্থে’ নেওয়া হয়েছে এবং এটি একটি প্রশাসনিক রুটিন প্রক্রিয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব কর্মকর্তাই সম্প্রতি সরকারবিরোধী অবস্থানে ছিলেন এবং পরিবর্তিত এনবিআর কাঠামোর বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছিলেন। ফলে এই অবসরপ্রদান আদতে ‘শাস্তিমূলক বদলি বা ছাঁটাইয়ের কৌশলী রূপ’ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ রাজস্ব প্রশাসনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, “নিয়ম বহির্ভূত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কারণে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
নানা বিতর্ক, আন্দোলন, এবং দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত এনবিআরের বর্তমান রূপান্তর প্রক্রিয়া এক ঐতিহাসিক মোড় নিচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কেবল কাঠামোগত সংস্কারই নয়, নেতৃত্বেরও আমূল পরিবর্তন ঘটছে। তবে এ পরিবর্তন কতটা স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর হবে—তা নির্ভর করছে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ ও কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থার পুনর্গঠনের ওপর।
এই পরিস্থিতিতে আগামী দিনে এনবিআরের ভবিষ্যৎ কাঠামো, কর্মসংস্কৃতি ও কর আহরণ ব্যবস্থাপনা কোন পথে এগোবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ