
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের একবছর পূর্তিতে শহীদদের স্মরণে জাতীয় রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভা। মঙ্গলবার রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই সভায় দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করায় জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে। ৪৫টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা একমত পোষণ করেন যে, মতের পার্থক্য থাকলেও দেশের স্বার্থে সকলেই একসঙ্গে থাকতে এবং ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানকে প্রতিহত করতে কাজ করবেন।
সভায় উপস্থিত নেতারা প্রত্যেকেই দাবি করেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, তবে তা যেন কখনো প্রতিহিংসা কিংবা ধ্বংসাত্মক রূপ না নেয়। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদকে পুনরায় রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দেওয়া যাবে না এবং যারা এই অপশক্তিকে ফেরাতেই চেষ্টাকারী তাদের বিরুদ্ধে জনতাও রাস্তায় নেমে লড়াই করবে।
একাধিক নেতা বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য দরকার শক্তিশালী সংলাপ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। রাজনীতিতে বিভাজন থাকলেও সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় পার্টি (জাফর), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি, এনপিপি, লেবার পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয় দল, বাংলাদেশ এলডিপি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, ন্যাপ ভাসানীসহ মোট ৪৫টি রাজনৈতিক দল অংশ নেন। হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভিডিও বার্তায় তিনি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ‘ঐক্য বজায় রাখার’ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদদের তালিকা প্রস্তুত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের পরিবারের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এসব অপরাধে জড়িতদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
সভায় বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও, যিনি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসলে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। তার বক্তব্যের প্রশংসা করেন সভায় অংশ নেয়া অনেক নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, “একমাত্র স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন নয়, বরং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সব দল একসঙ্গে দাঁড়ানোর সংকল্প প্রকাশ করেছে। তবে পারস্পরিক দূরত্ব কমাতে হলে আরও ঘনিষ্ঠ সংলাপ দরকার।”
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, “ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন যেন না হয়, সে ব্যাপারে সব দলের ঐকমত্য স্পষ্ট। বিএনপি শুধু নিজেদের আদর্শ নয়, সকলকে নিয়ে কাজ করতে চায়, যা ইতিবাচক একটি দৃষ্টান্ত।”
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, “বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু জাতীয় স্বার্থ ও গণতন্ত্র রক্ষায় ঐক্যের সুর বজায় রাখতে হবে। তা না হলে জনগণের হতাশা ও অনাস্থা বাড়বে।”
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তা যেন কখনো রাজনীতিকে ব্যাহত না করে বরং জাতীয় স্বার্থে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে, সেটাই সভার মূল বার্তা। রাজনৈতিক বিরোধের মাঝে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করে এই আলোচনা সভা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখছে অনেক বিশ্লেষক।
এবারের এই ঐক্যবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ও অশান্তির শক্তিকে রুখে দিয়ে দেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। এ জন্য পারস্পরিক বিশ্বাস, সংলাপ ও সহযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ