
ছবি: সংগৃহীত
আমাদের নিত্যদিনের জীবনে রাস্তাঘাট, বাজার, গণপরিবহন কিংবা জনসমাগমস্থলে চলাফেরা করার সময় অনেক সময় দেখা যায় – কেউ একজন ভুলবশত কিছু টাকা, কয়েন, মানিব্যাগ কিংবা সোনা-গয়নার মতো মূল্যবান কিছু ফেলে গেছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান—কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস নিজের কাছে রাখা কি জায়েজ হবে? ইসলাম কী বলে এ বিষয়ে? এমন ঘটনার সম্মুখীন হলে একজন মুসলিমের জন্য কী করণীয়?
ইসলাম শান্তির ধর্ম, যেখানে মানবতা, সততা এবং অন্যের হক রক্ষা করাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা সামান্য অর্থ বা দামী কোনো বস্তু কুড়িয়ে পাওয়া একরকম পরীক্ষাও বটে—আপনি সেটা কীভাবে গ্রহণ করেন, কী করেন, সেটাই দেখবে আল্লাহ।
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে রাস্তায় পড়ে থাকা জিনিস (আরবি পরিভাষায়: লুকাতা) কুড়িয়ে পাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, তবে এর জন্য রয়েছে একটি স্পষ্ট প্রক্রিয়া ও দায়িত্ব।
যদি আপনি এমন কোনো টাকা বা বস্তু পান যার আর্থিক মূল্য খুব বেশি নয়—ধরা যাক ২০ টাকা, ৫০ টাকা বা ১০০ টাকার মতো—তাহলে প্রথম করণীয় হলো, আপনি মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।
জিনিসটি কোথায় পেয়েছেন, আশেপাশে কেউ খুঁজছেন কি না, তা খেয়াল করুন।
সম্ভব হলে আশেপাশের দোকান বা ভবনে জিজ্ঞেস করুন কেউ কিছু হারিয়েছেন কি না।
যদি কেউ না খোঁজেন, তাহলে বস্তুটি নিজের কাছে সতর্কভাবে রেখে দিন।
পরবর্তী সময়ে যদি কেউ এসে হারানো টাকার বা বস্তুটির নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে মালিকানা দাবি করেন, তবে সেটা তাঁকে ফেরত দিন। তবে যদি দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায় এবং কেউ মালিকানা দাবি না করেন, তাহলে ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, ওই টাকা বা জিনিস আসল মালিকের নিয়তে কোনো গরিব মানুষকে সদকা করে দিতে হবে।
যদি কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসের আর্থিক মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি হয়—যেমন মোবাইল ফোন, মানিব্যাগে অনেক টাকা, স্বর্ণালংকার ইত্যাদি—তাহলে করণীয় আরও বেশি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পালন করতে হবে।
সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করবেন মালিককে খুঁজে বের করার জন্য।
আপনি চাইলে মাইকিং, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বা নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার মতো উদ্যোগ নিতে পারেন।
এ সময় আপনার খরচ যদি হয়, এবং পরে মালিক পাওয়া যায়, তাহলে পারস্পরিক সম্মতিতে খরচের অর্থ আপনি নিতে পারবেন।
খোঁজাখুঁজির সময় পেরিয়ে গেলে, যথাসম্ভব এক বছর পর্যন্ত মালিকের জন্য অপেক্ষা করবেন।
এই সময়সীমায় কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটি যত্নসহকারে নিজের হেফাজতে রাখবেন। কেউ এসে দাবি করলে সঠিক প্রমাণসহ তাঁকে ফেরত দেবেন। তবে এক বছরের মধ্যে কেউ না এলে, শরিয়তের নির্দেশ অনুসারে বস্তুটি মালিকের নামে সদকা করে দিবেন। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবেন এবং গুনাহ থেকে মুক্ত থাকবেন।
এই বিষয়ে ইসলামী ফিকহ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে অনেক ফকিহ (ইসলামি আইনজ্ঞ) বলেছেন, যদি আপনি নিজেকে গরিব, অভাবী বা আর্থিক সমস্যায় রয়েছেন বলে মনে করেন, এবং এক বছর অপেক্ষার পরও মালিক না মেলে, তাহলে আপনি ঐ বস্তুটি নিজেও ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার কোনো গুনাহ হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, এটি মূল মালিকের আমানত হিসেবেই গ্রহণ করা হয়েছে, এবং যদি ভবিষ্যতে মালিক উপস্থিত হন, তাহলে তাঁর জিনিস ফেরত দেওয়া ওয়াজিব থাকবে।
অনেকে ভুল করে ভাবেন কুড়িয়ে পাওয়া টাকা মসজিদে দান করে দেওয়া উত্তম। কিন্তু ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু মসজিদে দান করা ঠিক নয়। কেননা, এটা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির হক। সুতরাং তা সদকা করলেও করতে হবে মালিকের নিয়তে গরিবদের মধ্যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি হারানো বস্তু পায়, সে যেন এর খবর দেয় এক বছর পর্যন্ত। এরপর যদি মালিক আসে, তবে তাকে ফিরিয়ে দেবে। না এলে তা সদকা করে দেবে।” (সহিহ বুখারি)
রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া অর্থ বা বস্তুর সঙ্গে দায়িত্ব, সততা ও ইমানদারির সম্পর্ক জড়িত। এটি যেন হালকাভাবে নেওয়ার মতো বিষয় নয়। ইসলাম কেবল রীতিনীতির ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনবিধান, যেখানে মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ বিচারাধীন।
তাই আপনি যদি কোনো হারানো জিনিস পান, তাতে লোভ বা গাফলতির কোনো জায়গা নেই। যথাযথ প্রচেষ্টা, সদিচ্ছা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে সেই বস্তু হেফাজতে রাখা, মালিক খোঁজা এবং প্রয়োজনে সদকা করা—এই ধারায় চললে আপনি একজন সৎ ও দায়িত্বশীল মুসলিম হিসেবে পরিচিত হবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমানতের হক রক্ষা করার তাওফিক দিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ