
ছবি: সংগৃহীত
মানবজীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী, উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে যৌবনকাল। শৈশবের নিষ্পাপতা এবং বার্ধক্যের দুর্বলতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই সময়টি একদিকে যেমন কর্মক্ষমতা, তেমনি আত্মসংযম ও সাধনার সুযোগের স্বর্ণদ্বার খুলে দেয়। এই সময়টাই একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সময়। ইসলামও এই যৌবনকালকে ইবাদতের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বিবেচনা করেছে।
হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবে যেসব সৌভাগ্যবানদের একজন হবে সেই যুবক, যে যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থেকেছে। অর্থাৎ, তরুণ বয়সে যখন গোনাহের আকর্ষণ প্রবল, তখন যদি কেউ আত্মসংযমের মাধ্যমে নিজেকে সংযত রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জীবন গঠন করে, তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনন্য।
মানবজীবনের উত্থান ও পতনের অন্যতম নির্ধারক হচ্ছে এই যৌবন। শারীরিক শক্তি, মানসিক স্পৃহা, চিন্তার বিশুদ্ধতা ও কর্মক্ষমতা—সবকিছু একসাথে থাকে এই সময়েই। যারা এই সময়কে পরিশ্রম, ইবাদত, সংযম ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে কাজে লাগায়, তারা বার্ধক্যে শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন কাটাতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যারা এই সময়কে নষ্ট করে, তারা বৃদ্ধ বয়সে অনুশোচনার অন্ধকারে ডুবে যায়।
এই বিষয়ে বিখ্যাত পারস্য কবি ও দার্শনিক আল্লামা শেখ সাদি ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থে একটি দারুণ ঘটনা তুলে ধরেছেন। একবার দামেস্ক সফরের সময় এক যুবক এসে তার সাহায্য চায়। সে জানায়, এক বৃদ্ধের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, সে ফার্সি ভাষায় কিছু বলছে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না। সাদি সেখানে গিয়ে বৃদ্ধের শিয়রে বসতেই শুনলেন, বৃদ্ধ বলছে—“আমি এক সময় বলতাম, আমার ইচ্ছাই পূরণ হবে। তৃপ্তিসহ ভোগ করতাম, বলতাম, আর প্রয়োজন নেই। আজ আর সেই সময় নেই। আজ মৃত্যুর দ্বারে, যৌবনের বর্ণিল দিনগুলো ধূসর হয়ে গেছে। হায়! যদি ফিরে পেতাম সেই সময়!”
এই ঘটনাটি নিছক কোনো গল্প নয়, বরং আমাদের জন্য গভীর এক শিক্ষা। যৌবনে আল্লাহর পথে না চললে, জীবনের সূর্য অস্তমিত হওয়ার সময় শুধু আফসোসই থাকে সঙ্গী।
বর্তমান সমাজে একটি ভয়ানক বাস্তবতা হলো—তরুণদের নিয়ে ইসলামী সমাজ ও দায়িদের চর্চা খুবই কম। সমাজের দাওয়াতি কাঠামো যেন বয়সের ভারে জর্জরিত। বৃদ্ধরা মসজিদে থাকলেও মসজিদে যুবকদের উপস্থিতি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি ইসলামী আন্দোলন ও দাওয়াতি কাঠামোতেও তরুণদের সম্পৃক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। তরুণদের মধ্যে যেখানে অপসংস্কৃতির বিস্তারে প্রায় ১৫০টির মতো স্যাটেলাইট চ্যানেল কাজ করছে, সেখানে ইসলামী দাওয়াতি মাধ্যমে তরুণদের জন্য কার্যকর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা নেই বললেই চলে।
যেখানে যুবসমাজ ফেসবুক, টিকটক, টুইটার ও ইউটিউবের চুম্বকে আটকে আছে, সেখানে এই মাধ্যমগুলো আলেমদের দাওয়াতি কাজের বাহন হিসেবে গড়ে ওঠেনি কেন? এই প্রশ্নটি আজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআন যখন নাজিল হয়েছিল, তখনকার তরুণরা কবিতা, গান ও সাহিত্যের প্রতি মোহগ্রস্ত ছিল। আল্লাহ তখন তাঁদের জন্য কুরআনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাহিত্য ও অলৌকিকতা এনে তাঁদের হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন। কাফেররা যখন দেখলো তরুণদের হৃদয় কুরআনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, তখন তারা শোরগোল ও গান-বাজনার আশ্রয় নিয়েছিল কুরআন থেকে যুবসমাজকে দূরে রাখতে। কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে—“কাফেররা বলে, তোমরা এ কুরআন শুনবে না এবং এটি আবৃত্তি করার সময় হট্টগোল সৃষ্টি করবে, তাহলে তোমরা বিজয়ী হবে।” (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ২৬)
তরুণরাই সমাজের চালিকাশক্তি। আগামী দিনের নেতৃত্ব তাদের হাতেই। এই কারণে ইসলামী দাওয়াতি প্রচেষ্টায় তরুণদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। শুধু বক্তৃতা কিংবা ওয়াজ নয়, তরুণদের জন্য যুগোপযোগী দাওয়াতি কৌশল, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক উদ্যোগ এবং শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুলেও কুরআন-হাদিস ভিত্তিক ক্লাব, আলোচনা এবং দিকনির্দেশনা প্রচলন করতে হবে।
অনেক দায়ি বা আলেম নিজ সন্তানদের দাওয়াতি কাঠামোর মধ্যে আনতে ব্যর্থ হন। অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছে—“হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।” (সূরা তাহরিম, আয়াত ৬)। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে ইসলামি দাওয়াতের অগ্রযাত্রা। একজন তরুণ যদি নিজের ঘর থেকেই দীন শেখে, ইবাদতের প্রতি ভালোবাসা অর্জন করে, তবে সমাজেও সে আলো ছড়াবে।
তরুণ বয়সে ইবাদতের অভ্যাস জীবনকে যেমন প্রশান্ত করে, তেমনি ভবিষ্যৎ বার্ধক্যকে করে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ। আল্লাহর পথে সাধনা করে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। একজন যুবক যখন তাহাজ্জুদের নামাজে উঠে, কুরআন তেলাওয়াত করে, প্রতিদিন সালাত আদায় করে, জিনা-ব্যভিচার ও মদ-পান থেকে বিরত থাকে, তখন সে শুধু একজন ধার্মিক নয়, বরং একজন ভবিষ্যৎ নেতা, আদর্শ পিতা ও সমাজ সংস্কারকের রূপ নেয়।
যৌবন একটি অফুরন্ত শক্তির সময়। এই সময়টিকে ইবাদত, শিক্ষা, চরিত্রগঠন এবং দাওয়াতের জন্য কাজে লাগানো উচিত। ইসলাম আমাদের এই সময়টির প্রতিটি মুহূর্তকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এই মূল্যবান সময়ের যথাযথ ব্যবহার করার তৌফিক দিন।
“আজকের তরুণই আগামীর সমাজ গঠনের স্থপতি। তাই ইসলামের দাওয়াত, ইবাদত ও নৈতিক চেতনায় তাদের প্রস্তুত করতে হবে এখনই—আগামী নয়।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ