
ছবি: সংগৃহীত
আজ ১৪৪৭ হিজরি সনের ৩ মহররম। চন্দ্র মাসের হিসেবে শুরু হয়েছে এক মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ সময়—মহররম মাস। কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী, এই মাসটি ইসলামি বর্ষপঞ্জির অন্যতম সম্মানিত মাস। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর বিধানে আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই বছরে ১২ মাস রয়েছে, তার মধ্যে চারটি পবিত্র মাস।’ (সূরা তওবা: ৩৬)
হাদিস শরিফে নবীজী মুহাম্মদ (সা.) আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, এই চারটি পবিত্র মাস হলো—জিলকদ, জিলহজ, মহররম এবং এককভাবে রজব। এই মাসগুলোকে সম্মানিত করার নির্দেশ এসেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে। যার মধ্যে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে মহররম মাস, কারণ এতে রয়েছে ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে ভরপুর দিন—‘আশুরা’।
আশুরা বলতে সাধারণত বোঝানো হয় মহররমের ১০ তারিখ। ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটির গুরুত্ব বহু প্রাচীন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) হিজরতের পর যখন মদিনায় পৌঁছেন, তখন দেখলেন ইহুদিরা ১০ মহররম রোজা পালন করছে।
নবীজি তাদের জিজ্ঞেস করলেন—‘তোমরা কেন এদিন রোজা রাখো?’ তারা উত্তর দিলো, এ দিন আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও তার অনুসারীদের ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতায় মুসা (আ.) এ দিন রোজা রাখতেন এবং আমরাও তাঁর অনুসরণে তা পালন করি।
নবীজী তখন বললেন, “আমরা মুসার অনুসরণে তোমাদের চেয়েও অধিক হকদার।” এরপর তিনি নিজেও রোজা পালন করেন এবং মুসলমানদের তা পালনের নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি: হাদিস ৩৩৯৭)
অবশ্য সাহাবিগণ পরবর্তীতে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসুল! ইহুদিরাও তো এই দিন রোজা রাখে। আমরা কি তাহলে তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য করব?” জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখও রোজা রাখব।” (সহিহ মুসলিম: হাদিস ১১৩৪)
অন্য হাদিসে আরও এসেছে, “তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না হওয়ার জন্য ১০ তারিখের আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখো।” (মুসনাদে আহমদ: হাদিস ২১৫৪)
রোজার পদ্ধতি: ৯-১০ অথবা ১০-১১
উপরে বর্ণিত হাদিসসমূহের আলোকে ইসলামি ফিকহবিশারদগণ একমত হয়েছেন যে, আশুরার রোজা একদিন নয়, বরং দুটি দিন রাখা সুন্নত।
প্রথম পদ্ধতি: ৯ ও ১০ মহররম (একটি রোজা ইহুদিদের সঙ্গে মিল এবং অন্যটি পার্থক্যস্বরূপ)
বিকল্প পদ্ধতি: ১০ ও ১১ মহররম (যদি কেউ ৯ তারিখ রোজা রাখতে না পারেন)
এই রোজা ফরজ নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব বা নফল ইবাদত। অতএব কেউ একটি রোজা রাখলেও তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে, কিন্তু দুই দিন রোজা রাখাই রাসুলের চর্চার অধিক অনুরূপ।
আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, “আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, আশুরার রোজা এক বছর আগের গুনাহর কাফফারা হবে।” (সহিহ মুসলিম: হাদিস ১১৬২)
এখান থেকে বোঝা যায়, এই রোজা ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি, অতীত গুনাহর ক্ষমা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি দুর্লভ সুযোগ।
মহররম মাস কেবল আশুরার রোজাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের ইতিহাসে এ মাস একটি করুণ অথচ গৌরবময় অধ্যায়ও বহন করে—কারবালার ময়দানে মহানবীর প্রিয় নাতি হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছিল এই আশুরার দিনেই। যদিও এ উপলক্ষে শোক পালনের জন্য রোজা নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়াই এই মাসের প্রকৃত শিক্ষা।
সুতরাং, ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে মহররমের আশুরা উপলক্ষে দুটি রোজা পালন করা সুন্নত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি নফল ইবাদত। রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখা সর্বোত্তম। এই রোজা শুধু একটি ঐতিহাসিক অনুস্মরণ নয়, বরং তা আত্মশুদ্ধি, তাওবা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য মাধ্যম।
আসুন, আমরা সবাই মহররমের গুরুত্ব অনুধাবন করি এবং আশুরার রোজার মাধ্যমে আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ