
ছবি: সংগৃহীত
ইসলামের ইতিহাস, রেওয়ায়েত ও বিশ্বাসে ‘মহররম’ একটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মাস। হিজরি সনের প্রথম মাসটি শুধু নতুন বছরের সূচনা হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তা নানা ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক হিসেবে বিবেচিত। মহররমের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিন হচ্ছে ১০ মহররম, অর্থাৎ আশুরা, যে দিনটি বহু নবী-রাসুল, ঐতিহাসিক ঘটনা এবং সর্বোপরি ইসলামি আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের এক অনন্য নিদর্শনের সাক্ষ্য দেয়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকেই আজ আশুরাকে শুধু কারবালার দিন বলেই জানেন, কিন্তু এর প্রকৃত তাৎপর্য এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হাদিসভিত্তিক আমল ও ফজিলত অনেকাংশেই অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—মহররম ও আশুরার ফজিলত, নবীজির নির্দেশিত আমলসমূহ, প্রাচীন কালের ঐতিহাসিক ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং শেষে ৬১ হিজরিতে সংঘটিত কারবালার নির্মম ট্র্যাজেডি ও তার অনন্য শিক্ষা।
আশুরা মানে শুধুই শোক নয়, বরং তা ফজিলতেরও দিন। একাধিক সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মহররমের গুরুত্ব এবং এই মাসে বিশেষভাবে রোজা রাখার উৎসাহ দিয়েছেন।
মুসনাদে আহমদ (হাদিস নং ২১৫৪) সূত্রে পাওয়া যায়,“তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য এড়াতে ১০ মহররমের আগের দিন (৯ তারিখ) অথবা পরের দিন (১১ তারিখ) আরও একটি রোজা রাখো।”
অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররম মাসের রোজা, আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১/৩৫৮)
অর্থাৎ, আশুরা শুধু শোকের দিন নয়—বরং এটি এমন একটি দিন, যখন নফল রোজার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এই দিন ইবাদত-বন্দেগি, রোজা রাখা, দান-সদকা করা এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আশুরার দিন কেবল কারবালার নয়, বরং বহু ঐতিহাসিক অলৌকিক ঘটনার স্মারক। হাদিস ও প্রাচীন ইসলামি গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে, এই দিনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়েছে—
আদম (আ.)-এর সৃষ্টি এবং রূহ ফুঁক দেওয়া।
আদম ও হাওয়া (আ.)-এর পৃথিবীতে প্রেরণ এবং দীর্ঘ অনুতাপ শেষে এই দিনেই ক্ষমা লাভ।
ইবরাহিম (আ.)-কে আগুন থেকে মুক্তি প্রদান।
নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থেমে যাওয়া।
ইউনুস (আ.)-কে মাছের পেট থেকে উদ্ধার।
আইয়ুব (আ.)-এর সুস্থতা লাভ।
ইউসুফ (আ.)-এর ৪০ বছর পর বাবার সঙ্গে পুনর্মিলন।
মুসা (আ.)-কে লোহিত সাগর পার করে ফেরাউনের থেকে রক্ষা এবং ফেরাউনের ধ্বংস।
সুলায়মান (আ.)-এর রাজত্ব ফিরে পাওয়া।
এই সব ঘটনা কেবল অলৌকিক নয়, বরং মানবজাতির ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের নিদর্শন হিসেবে আশুরাকে চিহ্নিত করেছে। সুতরাং, আশুরা দিনটি কেবল ঐতিহাসিক নয়, বরং তা তাওহিদ, ঈমান ও ধৈর্যের এক প্রামাণ্য প্রতীক।
তবে আশুরা দিনটি সর্বোচ্চ গৌরবের পালক অর্জন করে ৬১ হিজরিতে, কারবালার প্রান্তরে হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দৌহিত্র, জান্নাতি যুবকদের নেতা হজরত হোসাইন (রা.) ১০ মহররম দিন সত্য, ন্যায় এবং ইসলামের মূল আদর্শ রক্ষার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন।
ইয়াজিদের স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে হজরত হোসাইন (রা.) পরিবারসহ কারবালার ময়দানে অবস্থান নেন। একদিকে তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় অল্প, খাদ্য ও পানি ছাড়া মানবেতর অবস্থায়, অপরদিকে ছিল ইয়াজিদের সুসজ্জিত সেনাবাহিনী। ফোরাত নদীর তীর ঘেঁষা প্রান্তরেই সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম নির্মম, হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড।
হজরত হোসাইনের (রা.) দেহে কারবালার ময়দানে ৩৩টি বর্শা, ৩৪টি তরবারি এবং অসংখ্য তীরের আঘাত ছিল—যা শুনে আজও মুসলমানদের হৃদয়ে অশ্রু নামে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কেউই রেহাই পাননি। এ হত্যাকাণ্ডকে ইসলামী ঐতিহাসিকগণ মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম করুণ ঘটনা বলে বর্ণনা করেন।
কারবালা কেবল এক প্রাসাদবিরোধী যুদ্ধ নয়, বরং সত্যের জন্য আত্মত্যাগ, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার এক অমর ইতিহাস।
আমাদের সমাজে একধরনের প্রবণতা দেখা যায়, আশুরার আলোচনা মানেই কারবালার ইতিহাসের সীমাবদ্ধ আলোচনায় থেমে যাওয়া। অথচ, রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরা সম্পর্কে যেসব আমল, হাদিস, উপদেশ রেখে গেছেন তা প্রায় অনুচ্চারিত থাকে। আমাদের মাহফিল, বয়ান, ওয়াজে যদি কেবল কারবালাকেন্দ্রিক আবেগ-ভিত্তিক আলোচনা হয়, তাহলে রোজা, দান, তওবা, তাহাজ্জুদের মতো আমলগুলো গুরুত্ব হারিয়ে যাবে।
ইসলামে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। হজরত হোসাইনের (রা.) আত্মত্যাগ আমাদের জন্য প্রেরণা। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের উচিত নবীজির (সা.) আদর্শ, হাদিস এবং মহররম মাসের পূর্ণ ফজিলত ও আমল সম্পর্কে জানা, চর্চা করা ও সমাজে প্রচার করা।
মহররম ও আশুরা কেবল মুসলিম উম্মাহর শোকের দিন নয়, বরং তা ফজিলত, কৃতজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মত্যাগের প্রতীক। একদিকে নবীদের অলৌকিক ঘটনা, অন্যদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস অনুযায়ী রোজা ও আমল; আবার একইসঙ্গে হজরত হোসাইন (রা.)-এর কারবালায় শাহাদাত—সব মিলিয়ে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও শিক্ষা বহনকারী দিন।
আসুন, আমরা মহররম ও আশুরাকে শুধুই আবেগের দিন হিসেবে না দেখে, ইবাদত, ইতিহাস, শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ উপলব্ধিতে পরিণত করি। তাহলেই মহররম ও আশুরা হবে ইসলামের আদর্শকে ধারণ করার একটি পূর্ণাঙ্গ উপলক্ষ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ