
ছবি: সংগৃহীত
আদালতের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা এবং বিচারিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (আইসিটি-১)। একইসঙ্গে তাঁর সঙ্গে আলোচিত একটি ফোনালাপে অংশগ্রহণকারী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলকেও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (৩ জুলাই) বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই দণ্ডাদেশ দেন। মামলাটি শুরু হয়েছিল একটি ফাঁস হওয়া ফোনালাপকে কেন্দ্র করে, যেটি গত বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলকে বলতে শোনা যায়: “আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, তাই আমি ২২৭ জনকে হত্যা করার লাইসেন্স পেয়েছি।”
এই বক্তব্যকে ট্রাইব্যুনাল চরম অবমাননাকর, বিভ্রান্তিকর ও বিচারিক প্রক্রিয়াকে ভয়ভীতির মাধ্যমে ব্যাহত করার স্পষ্ট প্রয়াস হিসেবে গণ্য করে।
আইসিটি-১-এর প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গত ৩০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন যে, এই অডিও ক্লিপটি চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত মামলায় সাক্ষীদের প্রভাবিত করার স্পষ্ট প্রয়াস। তাঁর ভাষায়, “এই বক্তব্য শুধু সাক্ষী নয়, পুরো বিচার ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের হুমকি। এটা একটা নজিরবিহীন আদালত অবমাননা।”
তিনি আরও জানান, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রযুক্তিগত ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে—ফাঁস হওয়া অডিওতে কণ্ঠস্বরটি শেখ হাসিনারই।
আইসিটি-১ গত ২৫ মে’র মধ্যে শেখ হাসিনা ও শাকিল বুলবুলকে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কেউই আদালতে উপস্থিত হননি বা লিখিত ব্যাখ্যাও দেননি। এরপর ২টি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে তাদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়, যাতে তারা ৩ জুনের মধ্যে হাজির হন বা আইনজীবীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেন।
কিন্তু শেখ হাসিনা হাজির না হওয়ায় এবং তাঁর আইনজীবীরাও আদালতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করায়, ট্রাইব্যুনাল বুধবার সরাসরি অনুপস্থিতিতে সাজা ঘোষণা করে।
ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়েছে, এই দণ্ড বিনাশ্রম এবং যেদিন হাসিনা ও বুলবুল আত্মসমর্পণ করবেন বা গ্রেপ্তার হবেন, সেদিন থেকে কার্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী এমন মন্তব্য করলে তা শুধু আদালতের জন্য নয়, পুরো আইনি ব্যবস্থার জন্যই মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এটি সাধারণ নাগরিক ও সাক্ষীদের মধ্যে ভয় সঞ্চার করে এবং বিচারাধীন মামলাকে প্রভাবিত করতে পারে।
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, আদালত এই রায় দিয়ে একটি মূল্যবান বার্তা দিয়েছে—আইন সকলের জন্য সমান এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন।
এই রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। শেখ হাসিনা বর্তমানে পলাতক এবং দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় তাঁর অনুপস্থিতিতে এই রায় রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ।
একদিকে সাবেক একজন শীর্ষ নেতার বিচারিক প্রক্রিয়ায় এমন রায় নজিরবিহীন, অন্যদিকে এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে।
এই রায় শুধু আদালত অবমাননার জন্য নয়, বরং বিচারব্যবস্থাকে ভয় দেখানো ও প্রভাবিত করার অপচেষ্টা প্রতিরোধের একটি দৃষ্টান্ত। এতে করে বিচারিক প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়: “এ ধরনের বক্তব্য বিচারাধীন মামলার ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের মধ্যে ভয় তৈরি করে, যা সরাসরি ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলায় ছয় মাসের সাজা ঘোষণা শুধু আইনি পদক্ষেপ নয়, এটি রাজনৈতিক ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকছে। এখন দেখার বিষয়, শেখ হাসিনা কি আত্মসমর্পণ করবেন, নাকি আরও দীর্ঘ সময় পলাতক থাকবেন—এবং তার অনুপস্থিতিতে এই রায়ের বাস্তব কার্যকারিতা কতটা হবে।
যদিও আইসিটি-১ বলছে, আইন অনুযায়ী দণ্ড কার্যকর করা হবে, তবে দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ এখন এই রায়ের বাস্তব প্রয়োগের দিকেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ