
ছবি: সংগৃহীত
দেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সারাদেশে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয় বলেই অভিযোগ উঠেছে। সেই আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা ভয়াবহ শক্তি প্রয়োগ করেছিল, তার কিছু তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মামলার শুনানিতে।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি উপস্থাপন করেন। তিনি আদালতকে জানান, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন দমন করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায়ই ব্যবহার করা হয় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড তাজা বুলেট।
এই বিপুল পরিমাণ গুলি ব্যবহার করে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে রক্তাক্ত করে তোলা হয়, যার জন্য তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরাসরি দায়ী করেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের সরাসরি নির্দেশে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সারা দেশে পদ্ধতিগতভাবে হত্যাযজ্ঞ, গুম ও নিপীড়ন চালানো হয়।”
এই মামলায় তিনজন অভিযুক্তের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের জন্য আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমীর হোসেন আদালতে বলেন, “আমার দায়িত্ব নির্দোষ প্রমাণ করে নজির স্থাপন করা। আমি বিশ্বাস করি, সঠিক আইনি পন্থায় সত্য উদঘাটন করা সম্ভব।”
অন্যদিকে, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন এবং এদিন তাকে আদালতে হাজির করা হয়। তবে তিনি আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত থাকলেও কোনো বক্তব্য দেননি। মামুনের পক্ষে আইনজীবী ট্রাইব্যুনালকে জানান, “এই মুহূর্তে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে চান না।”
আদালত এদিনের শুনানি শেষে জানায়, আগামী সোমবার (৭ জুলাই) এই মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ তখন মামলার অগ্রগতি নিয়ে পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন।
২০২৪ সালের ১ জুলাই শুরু হওয়া ছাত্র ও তরুণ সমাজের ‘বৈষম্যবিরোধী জুলাই আন্দোলন’ প্রথমে রাজধানী ঢাকা, পরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ।
কিন্তু সরকার তখন তা দমন করতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ সকল বাহিনীকে সক্রিয় করে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহারের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ঘটনার প্রচার শুরু করলে আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ তৈরি হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে রাষ্ট্রীয় বাহিনী শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং আন্দোলনকারীদের মধ্যে বহুজনকে গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতে হয়েছে। এসব অপরাধ রাষ্ট্রীয় মদদে সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলাটি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে। কারণ প্রথমবারের মতো কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দমন-পীড়নকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, পুরো বিষয়টি দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত এবং নিরপেক্ষ রায় নিশ্চিত করতে হবে। তেমনই মত বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আসিফ নজরুলেরও। তিনি বলেন, “এই মামলা প্রমাণ করবে, রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে বিচারিক ব্যবস্থা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।”
৩ লাখের বেশি গুলি ছুড়ে একটি ছাত্র ও নাগরিক আন্দোলন দমনের অভিযোগ এখন বিচারের মুখোমুখি। ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত তিনজন সাবেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা এদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। ৭ জুলাইয়ের শুনানিতে এই মামলার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই মামলার রায় শুধু তিন ব্যক্তির বিচার নয়, বরং একটি সময়ের বিচার—যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির প্রশ্নে পুরো জাতি তাকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দিকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ