
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সংঘটিত রাজনৈতিক টার্নওভার শুধু দেশের প্রশাসনিক কাঠামো নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও সৃষ্টি করেছে গভীর অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর একটি অংশের আচরণ এখন সরকারি প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকার পতনের পরপরই দেখা যায়, অনেক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাতে শুরু করেন। কেউ কেউ হঠাৎ করেই ছুটি না নিয়ে কর্মস্থল থেকে উধাও হয়ে যান। কেউ গা ঢাকা দেন, কেউ আবার সীমান্ত পেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান বলেও শোনা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক অনুপস্থিত কর্মকর্তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (১ জুলাই) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখা থেকে পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সাবেক ডিআইজিসহ তিনজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন তিনটিতেই সই করেছেন উপসচিব নাসিমুল গনি।
বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন:
নূরে আলম মিনা – তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি এবং বর্তমানে পদায়িত ছিলেন রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে। তবে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে তিনি গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।
মানস কুমার পোদ্দার – ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক ডিসি ও বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত এই কর্মকর্তা বিনা অনুমতিতে গত বছরের ১৮ অক্টোবর থেকেই অনুপস্থিত।
রহমত উল্লাহ চৌধুরী – গাজীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-২ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তিনিও ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে যোগ দেননি এবং কোন প্রকার ছুটি গ্রহণ করেননি।
তাদের সবাইকে সরকারি চাকরি বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ৩(গ) অনুযায়ী পলায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত করে, বিধি ১২ উপবিধি (১) অনুসারে অনুপস্থিতির দিন থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তকালীন তারা কেবলমাত্র খোরপোষ ভাতা পাবেন।
এর আগেই ২৬ জুন আরও ১৩ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন পুলিশ সুপার (এসপি), আটজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) ও দুজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)।
বরখাস্ত হওয়া ওই ১৩ কর্মকর্তার তালিকায় উল্লেখযোগ্য নামগুলো হল:
-
মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, এটিইউয়ের সাবেক এসপি, বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত।
-
মো. শাহজাহান, রংপুর জেলার সাবেক এসপি, বর্তমানে চট্টগ্রাম রেঞ্জে সংযুক্ত।
-
গোলাম মোস্তফা রাসেল, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এসপি, বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত।
-
এস এম জাহাঙ্গীর হাছান, নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
-
শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা বিভাগের সাবেক এডিসি, বর্তমানে সিলেট ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
-
এস এম শামীম, ডিএমপির সাবেক এডিসি।
-
ইফতেখায়রুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক এডিসি, বর্তমানে কক্সবাজার এপিবিএনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
-
মিশু বিশ্বাস, ডিবি'র সাবেক এডিসি, বর্তমানে জামালপুর ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
-
হাসানুজ্জামান মোল্যা, রাঙ্গামাটি এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
-
রুবাইয়াত জামান, সুনামগঞ্জ ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
-
মাসুদুর রহমান, বরিশাল র্যাব-৮ এর ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার।
-
মো. মাহমুদুল হাসান, রাজারবাগ পুলিশ টেলিকম ভবনের সহকারী পুলিশ সুপার।
-
মোহাম্মদ ইমরুল, কক্সবাজার উখিয়া এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরই কিছু পুলিশ কর্মকর্তা রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে সংশয়ে পড়েন। কেউ কেউ বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ফলে নতুন প্রশাসনের অধীনে নিজেদের অবস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
অন্যদিকে আইন ও প্রশাসন বিশ্লেষকদের মতে, এসব কর্মকর্তার আচরণ প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার লক্ষণ। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে পুলিশের কাঠামোগত স্থিতিশীলতায়।
প্রাক্তন আইজিপি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম এ কাইয়ুম বলেন, “এটা স্পষ্ট যে পুলিশের ভেতরে একটি বড় ধরনের অনাস্থা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে এমন সংকট দেখা দিতেই পারে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে হয়তো গা ঢাকা দিয়েছেন। আমরা তাদের সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং ভবিষ্যতে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেই যদি অসন্তোষ, অনুপস্থিতি ও অনিয়ম দেখা দেয়, তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক কাঠামো কতটা ঝুঁকির মুখে পড়ছে—সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, শৃঙ্খলা ফেরাতে আরও নজরদারি ও তদন্ত অব্যাহত থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ