
ছবি: সংগৃহীত
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও আলোচনায়। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ, এবং আমদানি খরচের চাপে পড়ে কয়েক মাস ধরে ওঠানামা করছিল রিজার্ভ। তবে সদ্যপ্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা সাম্প্রতিক মাসগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান মঙ্গলবার (১ জুলাই) গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.৬৮ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী হিসাব করা বিপিএম-৬ (Balance of Payments Manual-6) পদ্ধতিতে এই রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৬৬ বিলিয়ন ডলারে।
দুই ধরনের হিসাবের মধ্যে এই পার্থক্য এখন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের আলোচনার কেন্দ্রে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী যেখানে রিজার্ভ প্রায় ৩১.৬৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী তা প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার কম।
আইএমএফের বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয় শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ব্যয়যোগ্য, লিকুইড এবং মুক্ত মুদ্রা ও সম্পদ। এতে স্বর্ণ, সুদযুক্ত আমানত বা ফান্ডে বিনিয়োগের অর্থ, অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়—এমন অর্থ রিজার্ভের আওতায় আসে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে এসব ফান্ড, স্বর্ণ ও অন্যান্য বৈদেশিক সম্পদ যুক্ত থাকায় রিজার্ভের অঙ্ক বেশি দেখা যায়।
গত এক সপ্তাহেই রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
গত রোববার (৩০ জুন) বিপিএম-৬ অনুসারে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ২৬.৩২ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৩১.৩১ বিলিয়ন ডলার।
তারও আগে গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বিপিএম-৬ ভিত্তিক রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ৩০.৫১ বিলিয়ন ডলার।
এই কয়েক দিনের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ডলার, যা মূলত রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক প্রবণতার কারণে হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানান, “আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভ আজ (১ জুলাই) দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৬৬ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যা বিপিএম-৬ ফরম্যাটে উপস্থাপিত। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৬৮ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার।”
নিরাপদ মজুদ থাকলেও প্রশ্ন রয়ে যায়, কতটুকু রিজার্ভ ব্যয়যোগ্য (usable reserves) হিসেবে রয়েছে? আরিফ হোসেন খান জানান, বর্তমানে দেশের ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ এক হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি, অর্থাৎ প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। এই অংশটি সরাসরি আমদানি ব্যয় বা বৈদেশিক দেনা পরিশোধে ব্যবহারযোগ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিজার্ভে সাময়িক উন্নতি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এই চিত্র ধরে রাখতে হলে রপ্তানি আয়, বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণ এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার দর নিয়েও নজর রাখতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ রহমান বলেন, “রিজার্ভ বৃদ্ধির এই ধারা ধরে রাখতে গেলে বাণিজ্য ঘাটতি ও মুদ্রানীতির সমন্বয় ছাড়া উপায় নেই। কারণ শুধু সাময়িক রপ্তানি বৃদ্ধি বা ঋণ ছাড়ের মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানো টেকসই নয়।”
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও বিপিএম-৬ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের মধ্যে বড় ব্যবধান নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। সামগ্রিকভাবে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা আরও স্বচ্ছ, হিসাবসম্মত ও জনগণের আস্থাভাজন করার জন্য তথ্য উপস্থাপনে ঐক্য থাকা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এখন দেখার বিষয়, ভবিষ্যৎ মাসগুলোতে রিজার্ভ এই ইতিবাচক ধারায় কতটা টিকে থাকে এবং কতটা কার্যকরভাবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা অর্থনীতির সুরক্ষায় কাজে লাগাতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ