
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পশ্চিম উপকূলে সমুদ্রতীরবর্তী একটি ক্যাফেতে ভয়াবহ ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত ৩৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সোমবার (১ জুলাই) দিনগত রাতে সংঘটিত এই হামলায় আহত হয়েছেন আরও বহু নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং স্থানীয় বাসিন্দারা। আহতদের অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, এই ক্যাফেটি সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য পরিচিত একটি জায়গা ছিল, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ ও শান্তিপূর্ণ কাজের পরিবেশ থাকত।
গাজার আল-বাকা ক্যাফেটেরিয়া, যেখানে এই হামলা হয়, সেটি একটি তাঁবুর নিচে খোলা জায়গায় স্থাপিত ছিল, যা সম্প্রতি যুদ্ধের মাঝে যোগাযোগ ও বিশ্রামের জায়গা হয়ে উঠেছিল। হামলার পরে ক্যাফেটি সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ইসরাইলি যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সেখানে একটি গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
গাজার সিভিল ডিফেন্স ফোর্স জানায়, তারা প্রাথমিকভাবে ২০টি মরদেহ উদ্ধার করে, পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও ১৯ জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইসমাইল আবু হাতাব রয়েছেন, যিনি নিয়মিত ক্যাফেটিতে বসতেন।
আল-বাকা ক্যাফের নিয়মিত ক্যামেরাম্যান আজিজ আল-আফিফি বিবিসিকে বলেন: “আমি ক্যাফের কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম মাত্র, তখনই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। চোখের সামনে সহকর্মীরা মারা গেলেন। চারদিকে শুধু রক্ত, লাশ আর আর্তনাদ। এমন দৃশ্য আর কখনো দেখিনি।”
বিবিসি ও স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, এই ক্যাফেটিতে অনেক সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং তরুণরা নিয়মিত যেতেন। এটি ছিল গাজার অন্যতম শান্তিপূর্ণ স্থান, যেখানে দিনরাত চলত কাজ ও আলোচনা।
এই হামলার ভিডিও ফুটেজ ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায়—ইসরাইলি যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি ক্যাফের ওপর আঘাত করছে। ফুটেজে মাটিতে পড়ে থাকা অচেতন ও ক্ষতবিক্ষত মরদেহ এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হাহাকার করতে থাকা মানুষদের দেখা গেছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে “একটি পরিকল্পিত গণহত্যা” হিসেবে উল্লেখ করেছে।
গাজায় এই হামলা এমন এক সময় হলো, যখন ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে সংঘর্ষ নতুন করে শুরু হওয়ার পর থেকেই গাজার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করছে ইসরাইলি বাহিনী।
বিশ্লেষকদের মতে, এ হামলার মাধ্যমে ইসরাইল আবারও যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে দুর্বল করতে চাইছে। বিশেষ করে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও, ইসরাইলের আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে।
এই হামলার পর বহু পরিবার গাজার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। রাতভর গাজার নানা স্থানে বোমা বর্ষণ হয়েছে। ফলে আরও শত শত পরিবার ইতোমধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উদ্ধারকারী দলগুলো জানায়, আহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আল-আহলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কয়েক ডজন আহত ব্যক্তির অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এদিকে, হামলায় ক্ষোভে ফুঁসছে গাজার জনগণ। অনেকেই বলছে, তারা দিনশেষে একটি ক্যাফেতে শান্তিতে বসতে গিয়েছিল, কিন্তু সেটিও আর নিরাপদ নেই। যুদ্ধ আর মৃত্যু যেন এখন গাজায় প্রতিটি মুহূর্তের বাস্তবতা।
ইসরাইলি এই হামলার পর নরওয়ের একটি বড় বিনিয়োগ কোম্পানি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা দুইটি ইসরাইলি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে তাদের বিনিয়োগ বাতিল করেছে। তাদের ভাষ্য, “মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যেকোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ আমাদের নীতিমালার পরিপন্থী।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের বেসামরিক স্থানে ইসরাইলের বারবার হামলা তাদের যুদ্ধনীতি এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
গাজার সমুদ্রতীরবর্তী এই শান্তিপূর্ণ ক্যাফেতে প্রাণঘাতী হামলা প্রমাণ করে, ইসরাইলের হামলা এখন আর কেবল সামরিক লক্ষ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে নেই। সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট, এমনকি সাধারণ মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য স্থানগুলোও আজ ধ্বংসের শিকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এ হামলা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল— গাজায় মানবাধিকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
সূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, প্যালেস্টাইন মনিটর, সোশ্যাল মিডিয়া ফুটেজ
বাংলাবার্তা/এমএইচ