
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে ঢাকাই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে যে সংকট চলছে, তা আর কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি এক ধরনের মানসিক ও সাংগঠনিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির ভেতর থেকে উঠে আসা এই সংকটকে অনেকে তুলনা করছেন “নিজে বাঁচলে বাপের নাম” ধরনের প্রবণতার সঙ্গে। কেউ কারও কথা ভাবছেন না, সবাই কেবল নিজের সিনেমা, নিজের তারকা, নিজের মুক্তির তারিখ নিয়েই ব্যস্ত। এর ফলে যেটি ঘটছে তা হলো, পুরো ইন্ডাস্ট্রি আজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থে ছিন্নভিন্ন, এবং এই প্রবণতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যাচ্ছে ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা মুক্তির প্রবণতা-তে।
উৎসবেই ভরসা
বর্তমানে সিনেমা নির্মাতা ও প্রযোজকদের কাছে ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহা যেন ব্যবসায়িক মুক্তির একমাত্র আশার প্রতীক। এই দুই ঈদের চারপাশ ঘিরেই এখন সাজানো হচ্ছে মুক্তির ক্যালেন্ডার, তারিখ নির্ধারণ, শুটিং শিডিউল, এমনকি বড় তারকাদের সাইন করানোও। প্রযোজকরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে, সিনেমার স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়েই তাঁরা আগে নিশ্চিত হন—ঈদে সিনেমা মুক্তি দেওয়া যাবে তো?
এর কারণও সুস্পষ্ট। উৎসবকেন্দ্রিক সময়ে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক প্রবাহ বাড়ে ৫-১০ গুণ, যা বছরের অন্য কোনো সময়ের তুলনায় অভাবনীয়। সিনেমা হল মালিকরা বলেন, “ঈদ ছাড়া সিনেমা চালালে আমরা ক্ষতিতে ডুবে যাই। অনেক সময় প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ করে রাখাই ভালো মনে হয়।” তাই এক ধরনের বাধ্যবাধকতাই তৈরি হয়েছে—ঈদেই সিনেমা চালাতে হবে, না হলে আশানুরূপ দর্শক পাওয়া যাবে না।
উৎসবে মুক্তির হিড়িক আর দ্বন্দ্ব
এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা মুক্তি এক ধরনের ট্রেন্ড নয়, বরং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বছরের শুরুতেই নির্মাতারা ঘোষণা দিতে থাকেন—“ঈদে আসছি”। কেউ কেউ এক বছর আগেই প্রচারণা শুরু করেন। এর পেছনে যুক্তি হলো, ঈদে বড় তারকার সিনেমা মানেই বেশি হল, বেশি শো, বেশি দর্শক।
তবে এতে তৈরি হচ্ছে অন্য সমস্যা। একই ঈদে একাধিক সিনেমা মুক্তি পেলে ব্যবসা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ঈদে মুক্তি পেয়েছে ১০টির বেশি সিনেমা, যা একদিকে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে, অপরদিকে হল বুকিং নিয়ে হয়েছে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ। ছোট বাজেটের সিনেমাগুলো এই প্রতিযোগিতায় প্রায়শই জায়গা হারায়। তাদের জন্য হল পাওয়া তো দূরের কথা, পোস্টার লাগানোর সুযোগ পর্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে।
ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর পরিসংখ্যান
গত এক দশকে ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা এবং সেগুলোর আর্থিক সাফল্য বিশ্লেষণ করলে একটি চিত্র স্পষ্ট হয়—সংখ্যা বাড়লেও সফলতার হার কমছে।
২০২4 সালে ঈদ-উল-ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল ১১টি সিনেমা, ঈদ-উল-আজহায় ৫টি
২০২3 সালে ঈদ-উল-ফিতরে ৮টি, ঈদ-উল-আজহায় ৫টি
২০২2 সালে ঈদ-উল-ফিতরে ৪টি, ঈদ-উল-আজহায় ৩টি
২০১৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যেও ঈদে গড়ে ৩-৫টি সিনেমা মুক্তি পেত
কিন্তু এত সংখ্যক সিনেমার মধ্যে বাস্তবে ব্যবসা সফল হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি—যেমন ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’, এর আগে ‘নবাব এলএলবি’, ‘পাসওয়ার্ড’ বা ‘বেপরোয়া’। বাদবাকি বেশিরভাগ সিনেমাই লগ্নিকৃত অর্থের ১০ শতাংশও ফেরত আনতে পারেনি। পরিবেশক, হল মালিক ও বুকিং এজেন্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, উৎসবের আলোচনার বাইরে এই সিনেমাগুলোর বাস্তব ব্যবসায়িক সাফল্য ছিল অত্যন্ত সীমিত।
আলোচনায় থাকাই যেন মূল লক্ষ্য
অনেক প্রযোজক ও নির্মাতা নিজেরাও জানেন—ঈদে মুক্তি দিলেও পুঁজি উঠে আসবে না। তবুও তাঁরা উৎসব বেছে নেন, কারণ ঈদ মানেই অন্তত দুই সপ্তাহ আলোচনা থাকবে, প্রচারণার সুযোগ থাকবে, তারকা জ্বলজ্বল করবে। বছরের অন্য সময়ে মুক্তি দিলে সেই আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ হয় না। এভাবেই সিনেমা শিল্পে মূলধন না ফেরার বাস্তবতা নিয়েও নির্মাতা-প্রযোজকরা এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল লুজারস গেমে অংশ নিচ্ছেন—‘আলোচনায় থাকাই বড় কথা’।
ঈদের বাইরে সফলতার নজির
তবে কি ঈদ ছাড়া ব্যবসা হয় না? হয়—তবে প্রয়োজন ভালো গল্প, নির্মাণশৈলী, অভিনয় এবং গান। গত এক দশকে ঈদের বাইরেও সফলতা পাওয়া সিনেমার তালিকায় রয়েছে:
‘পরাণ’ (২০২২)
‘হাওয়া’ (২০২২)
‘ঢাকা অ্যাটাক’ (২০১৭)
‘আয়নাবাজি’ (২০১৬)
এই ছবিগুলো ঈদের বাইরে মুক্তি পেয়েও হলে দর্শক টানতে পেরেছিল, প্রমাণ করেছে যে কনটেন্ট ইজ কিং।
প্রেক্ষাগৃহ সংকট: মূলে ভালো সিনেমার অভাব
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্য বলছে, দেশে একসময় প্রেক্ষাগৃহ ছিল ১,৪৬০টি, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৫০টিতে। ব্যবসার আশায় ঢিমেতালে চালু থাকা ১০০টি হল ঈদ ছাড়া সারাবছর বন্ধ থাকে। হল মালিকরা বলছেন, “ঈদ ছাড়া এমন সিনেমা পাই না যেটা চালিয়ে দর্শক টানা যাবে।”
এই চিত্রটি প্রকাশ করে ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে বড় সংকট—সারা বছর ভালো কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে না। প্রযোজকরা ঈদের বাইরে সাহসী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, পরিচালকরা নির্মাণের সময় গল্পে মনোযোগ না দিয়ে ভাবছেন মুক্তির তারিখ নিয়ে, আর তারকাদের ঘিরে তৈরি হচ্ছে ‘সুপারস্টার রিলিজ স্লট’–এর অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
ঢাকাই সিনেমা এখন এক অদ্ভুত চক্রে আবদ্ধ—একদিকে উৎসবমুখী মুক্তির বাড়বাড়ন্ত, অন্যদিকে কনটেন্ট ও বাজার দুই জায়গাতেই দুর্বলতা। ঈদে আলোচনায় থাকতে গিয়ে ইন্ডাস্ট্রি বছরের ১০ মাস পিছিয়ে যাচ্ছে। এককেন্দ্রিক মুক্তির এই প্রবণতা কেবল হল বুকিং সমস্যা নয়, প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিণতিও ডেকে আনছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে দরকার বছরজুড়ে পরিকল্পিত মুক্তি, ভালো গল্পে বিনিয়োগ এবং ঈদের বাইরেও দর্শক টানার মত সাহসী নির্মাণ। তা না হলে উৎসবের ভিড়ে সিনেমা মুক্তির এই ট্রেন্ড, পুরো ইন্ডাস্ট্রিকেই নিয়ে যেতে পারে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ