
ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীর ওপর বর্বর যৌন সহিংসতা এবং সেই দৃশ্য ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নির্মম এই অপরাধের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। শোবিজ অঙ্গনের অনেক পরিচিত মুখসহ সাধারণ নাগরিকরাও নিজেদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন। অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহল।
এই ঘটনায় যেমন দেশের মানুষ শঙ্কিত, তেমনি ক্ষুব্ধ তারকারাও একের পর এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন—তীব্র ভাষায় নিন্দা জানিয়ে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আহ্বান জানিয়ে।
তমা মির্জা: জনপ্রিয় অভিনেত্রী তমা মির্জা সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, “মুরাদনগর, কুমিল্লা! বিভৎসতা! লজ্জা…!”— যা সামাজিক বাস্তবতার বেদনাদায়ক প্রতিফলন হয়ে উঠেছে।
মিশা সওদাগর: চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি ও খল অভিনেতা মিশা সওদাগর এ ঘটনায় সরাসরি অপরাধীর ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। তার পোস্টে উঠে এসেছে সামাজিক দায়বদ্ধতার জোরালো বক্তব্য—“দেশের প্রতিটি মানুষ শান্তিতে থাকুক। প্রতিটি নারী নিরাপদে থাকুক। প্রতিটি অন্যায়ের ন্যায় বিচার হোক। প্রতিটি ধর্ষকের ফাঁসি হোক।”
নুসরাত ফারিয়া: জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও উপস্থাপিকা নুসরাত ফারিয়া সংক্ষিপ্ত বার্তায় বলেছেন, “স্টপ রেপ।”—যা এ সময়ের সামাজিক আন্দোলনের স্লোগান হয়ে উঠছে।
দীঘি: অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘি লিখেছেন, “ধর্ষণকে না বলুন। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নীরবতাই সমর্থন। ধর্ষণ বন্ধ করুন।” তার বার্তায় স্পষ্ট আহ্বান, প্রত্যেকের প্রতিবাদই অপরিহার্য।
আরশ খান: এই অভিনেতা ফেসবুক পোস্টে বলেন, “কাপুরুষত্ব যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন তা কুপুরুষত্বে রূপ নেয়। জন্ম পরিচয়হীন না হলে একজন নারীর সঙ্গে এমন করা সম্ভব না। একবার জারজ সবসময় জারজই থাকে।”
মৌসুমী হামিদ: অভিনেত্রী মৌসুমী হামিদের ভাষ্য ছিল আরও গভীর। তিনি লিখেছেন, “মানুষ আর মানুষ নেই। পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ আর কোনো মানুষ থাকবে না। খুব শীঘ্রই।”
জিয়াউল রোশান: চলচ্চিত্র অভিনেতা জিয়াউল রোশান কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “জনসম্মুখে ফাঁসি চাই। তারা কোন দল করে, কোন ধর্মের সেটা জানা দরকার নাই, জানতেও চাই না। আর যারা সেই ভিডিও শেয়ার করছে, তারা ধর্ষকের মতোই অপরাধী। আপনারা ভিউখোর রাক্ষস। ফাজলামি ছেড়ে দেন, অতি সত্তর ভিডিও ডিলিট করেন।”
পারশা মাহজাবীন পূর্ণী: গায়ক ও অভিনেত্রী পূর্ণী লিখেছেন, “বিবস্ত্র বাংলাদেশ।” একটি শব্দেই যেন সমাজের সর্বাঙ্গে জর্জরিত ক্ষতচিহ্ন তুলে ধরেছেন।
জয় চৌধুরী: চলচ্চিত্র অভিনেতা জয় চৌধুরী লিখেছেন, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি… কুমিল্লার মুরাদনগরে নারীর সঙ্গে যা হয়েছে তার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি। যিনি ধর্ষণ করেছেন এবং যিনি ভিডিও করে পাবলিশ করেছেন—উভয়েরই বিচার চাই।”
আজমেরী হক বাঁধন: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী বাঁধন লিখেছেন, “ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু এই দেশে, এটি দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হচ্ছে। মানুষ তখনই কথা বলে, যখন ঘটনা ভাইরাল হয়। কিছুক্ষণ পর ভুলে যায় সবাই। কারণ প্রতিদিন নতুন কেলেঙ্কারি। একজন নারীর যন্ত্রণা আরেকটি নাটকের অংশ হয়ে যায়। এটা কেন এমন স্বাভাবিক হয়ে গেছে?”
লুৎফর হাসান: সংগীতশিল্পী লুৎফর হাসান তার ক্ষোভের কথা প্রকাশ করে লিখেছেন, “কোনো অপরাধী গ্রেফতার হলেই আমরা খুশি হই। আমরা থেমে যাই। আর থেমে যাওয়ার পরই শুরু হয় প্রকৃত অপরাধ। আলগোছে অপরাধী মুক্ত হয়, বিদেশে পালিয়ে যায়, আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আমরা ভুলে যাই। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।”
শিহাব শাহীন: নির্মাতা শিহাব শাহীন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি লিখেছেন, “পুলিশ এখনও (সুদিনের অপেক্ষায়) দায়সারা ভাবে কাজ করছে। নেতানেত্রীদের তোষণ করেই উন্নতির উপায় খোঁজে। বাংলাদেশে কিছুই বদলায় না, পুলিশও না।”
এই নারকীয় ঘটনায় এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে সামাজিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে, অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরাও সোচ্চার হচ্ছেন।
মানবাধিকার সংস্থা ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, শুধুমাত্র মামলা বা প্রতিবাদ নয়—এই সমাজের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের দায় নিয়ে রাষ্ট্রকে এখনই জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
এই ঘটনায় শুধু একটি নারীর মর্যাদা হানি হয়নি, আহত হয়েছে পুরো জাতি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরাধের প্রশ্রয়দাতা—সামাজিক, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক—সবাইকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন জনগণ।
এখন শুধু প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট বিচার এবং তা যেন হয় জনসম্মুখে, দৃষ্টান্তমূলক। যাতে আর কোনো নারীর আর্তনাদ ভাইরাল না হয়, বরং প্রতিটি অপরাধীর মুখে লাগে ন্যায়বিচারের কলঙ্কচিহ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ