
ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন মেয়াদের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির চারটি মূল লক্ষ্য ছিল—ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির হার কমানো এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন। এর মধ্যে প্রথম দুটি লক্ষ্য পূরণে আংশিকভাবে সফল হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও তা এখনো সহনীয় মাত্রায় আসেনি এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।
এই বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি জুলাইয়ের শেষে নতুন অর্থবছরের জন্য পরবর্তী মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর আগে জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতির কার্যকারিতা ও অর্জন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ ও আর্থিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মুদ্রানীতির কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মুদ্রানীতির মূল অর্জন, সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে এখন সর্বাত্মক বিশ্লেষণ চালানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমুখী (contractive) মুদ্রানীতি অনুসরণের সুপারিশ দিয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান অনেকটাই মধ্যপন্থী। তারা বলছে, আইএমএফের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়েও বাস্তবতার নিরিখে কৌশল ঠিক করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এরই মধ্যে জানিয়েছেন, সব কিছু অনুকূলে থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে সুদের হার নিয়ে পুনর্বিবেচনা তখন থেকেই শুরু হবে।
নতুন মুদ্রানীতির প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এবারও ঢাকার বাইরে মতামত গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে সিলেট ও রাজশাহীতে দুটি বৈঠকের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে, যেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজকর্মীদের মতামত নেওয়া হবে। গতবার চট্টগ্রামে প্রথম এই ধরনের আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল, যেটি ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিল।
এ ছাড়া রাজধানী ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হবে। সব মতামতের ভিত্তিতে খসড়া মুদ্রানীতি তৈরি হবে, যা পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে অনুমোদন পাবে এবং পর্ষদ সভায় তা চূড়ান্ত হবে।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় আড়াই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কার্যকর কারণ রয়েছে— হুন্ডির দাপট কমে আসা, রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাংকিং চ্যানেলে বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক ঋণের প্রবাহে ইতিবাচক গতি।
বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডলার পাচার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে, ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে একটি স্বস্তিদায়ক ভারসাম্য তৈরি হয়। এর আগে ডলারের দাম ১৩২ টাকায় পৌঁছে গেলেও এখন বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ করা হচ্ছে, এবং তা বর্তমানে ১২২.৭৬ থেকে ১২২.৯০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী সংকট তৈরি হয়। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে, ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ে, ডলারের দাম উর্ধ্বমুখী হয় এবং পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এখন কিছুটা উন্নতি এসেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ০৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশে। যদিও এই হার এখনো কষ্টসাধ্য সীমার ভেতরে থাকছে না।
চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এটি সংশোধন করে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা পূর্বানুমানের চেয়েও কম। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগ স্থবিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ভোক্তা ব্যয়ের ঘাটতি এই দুর্বল প্রবৃদ্ধির মূল কারণ।
চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, মে ও জুনের ঋণপ্রবাহের তথ্য যুক্ত হলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়বে।
মুদ্রানীতির কাঠামোগত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির একটি বড় অংশে নীতিনির্ধারকরা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত অনুযায়ী কড়া নীতিমালার বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অনিশ্চয়তা—দুটিই আগামী মুদ্রানীতির ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাইয়ের শেষ দিকে ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতিতে স্বল্পমেয়াদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়ন উভয়কে গুরুত্ব দিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল নিতে হবে। তা না হলে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বাস্তবভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রবৃদ্ধিমুখী মুদ্রানীতি। এখন দেখার বিষয়—বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা কতটা কার্যকর হয় আগামী মাসগুলোর নীতি কাঠামোতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ