
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট শুল্ক ও কর বিভাগে টানা কর্মবিরতি এবং সদ্যসমাপ্ত দুই দিনের পূর্ণাঙ্গ শাটডাউন দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এতে দেশের অর্থনীতিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা কাঁচামাল ও রফতানিযোগ্য পণ্য আটকে থাকায় দেশি-বিদেশি ক্রেতা-বিক্রেতা, আমদানিকারক, রফতানিকারক এবং শিপিং এজেন্টরা একযোগে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। শিপমেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাণিজ্যের ৯৩ শতাংশ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ। অথচ গত এক মাস ধরে এনবিআর সংস্কারের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যায়ক্রমে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে দিনে কয়েক ঘণ্টার কলম বিরতি থাকলেও শেষপর্যন্ত তা রূপ নেয় পুরোপুরি কার্যবিরতিতে। শনি ও রোববার (২৯ জুন) ছিল এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব—পূর্ণাঙ্গ শাটডাউন, যার ফলে কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক প্রবাহ।
বন্দরে কার্যত অচলাবস্থা
স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হয়। অথচ ধর্মঘটের দিন রোববার মাত্র ১৩৯টি কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছে। শুল্ক বিভাগের ছাড়পত্র না থাকায় আগে থেকেই বোঝাই করা জাহাজগুলো বন্দরের জেটি ত্যাগ করতে পারেনি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত কাঁচামালবাহী জাহাজগুলোও বন্দরের বহির্নোঙরে আটকে পড়ে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, “জাহাজগুলো বার্থে বসে থাকার ফলে প্রতিদিন অতিরিক্ত খরচ বাড়ছে। আর এটি শুধু বন্দরের নয়, সমগ্র দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করছে।”
শিপিং ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বন্দরের জেটিতে নির্ধারিত সময়ের বেশি অবস্থান করায় মাদার ভ্যাসেলগুলোকে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হয়। বহির্নোঙরে থাকা ১২৯টি জাহাজের মধ্যে ৩১টি কনটেইনারবাহী জাহাজ থাকলেও, ২১টি জাহাজই বন্দরে ভিড়তে পারেনি কাস্টমস ছাড়পত্র না থাকায়।
পোশাক খাতের বড় ধাক্কা
সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের প্রধান রফতানি খাত—তৈরি পোশাক শিল্পে। বিজিএমইএর তথ্যমতে, ধর্মঘটের দুই দিনে রফতানির জন্য প্রস্তুত ৫ হাজারের বেশি তৈরি পোশাকবাহী কনটেইনার জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। ফলে পণ্য আটকে যায় অফডকে। আমদানি করা কাঁচামালও বন্দরের শেডে আটকে পড়ে।
বিজিএমইএর পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জানান, “পণ্য আমদানি-রফতানিতে ধীরগতি বিদেশি ক্রেতাদের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেকেই পণ্যের ডেলিভারি বিলম্ব হওয়ায় দাম কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। ভবিষ্যতে তারা আদৌ অর্ডার দেবে কিনা, সে আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।”
এই ধাক্কা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বাংলাদেশের গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ঝুঁকিতে
এমএসসি শিপিংয়ের হেড অব অপারেশন আজমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “এই ধরনের অনিশ্চয়তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের ভাবমূর্তিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যবসায় আস্থার জায়গা নষ্ট হলে তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে পড়ে।”
জানা গেছে, ধর্মঘটের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউএস ধারণক্ষমতার বিপরীতে প্রায় ৪০ হাজার ৭২২ টিইইউএস কনটেইনার জমে যায়, যার মধ্যে বিপুল অংশই রফতানিযোগ্য পণ্য।
বিপুল আর্থিক ক্ষতি
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দুদিনের এই শাটডাউনে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি শুধুমাত্র আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের বিলম্বজনিত নয়; পণ্যভিত্তিক জরিমানা, জাহাজের অপেক্ষাকৃত বাড়তি অবস্থান, শ্রমিকদের মজুরি এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিভিত্তিক জটিলতা থেকেও এই ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, “জাহাজ বসে থাকলে তা শুধু দেশের ক্ষতি নয়, আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলোরও ক্ষতি হয়। আর তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ে চাপ তৈরি করে আমদানিকারক ও রফতানিকারকদের ওপর।”
ক্ষতির রেশ থাকবে আরও
যদিও এনবিআর কর্তৃক ঘোষিতভাবে শাটডাউন ও অন্যান্য কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে, তবে ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘদিন চলতে পারে। পণ্য ছাড়, কাগজপত্র যাচাই এবং পুনঃনিরীক্ষার কাজে যে জট তৈরি হয়েছে, তা স্বাভাবিক হতে আরও এক থেকে দুই সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের প্রশাসনিক অচলাবস্থা কেবল রাজস্ব আদায় কমিয়ে দেয় না, বরং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বারবার বাধাগ্রস্ত করে। এনবিআরের সংস্কার প্রশ্নে যতোই যুক্তি থাকুক, তা যদি বাণিজ্য ও উৎপাদনে এমন বিঘ্ন ঘটায়, তাহলে সেটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।
বাংলাবার্তা/এসজে