
ছবি: সংগৃহীত
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচয়ে প্রতারণা করা একটি সংঘবদ্ধ চক্রকে নিয়ে চলমান তদন্তে এবার ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রতারকদের ফাঁদে পা দেওয়া ভুক্তভোগীদেরও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে দুদক। এমনটাই জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র প্রতারক চক্রকে ধরা নয়, যারা তাদের কাছে অর্থ বা সুবিধা দিয়েছে বা আদান-প্রদানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল, সেই ব্যক্তিদেরও আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এতে একদিকে প্রতারকদের মোহভঙ্গ হবে, অন্যদিকে সচেতনতা বাড়বে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
দুদক জানায়, একদল প্রতারক দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের দুদক কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষ, এমনকি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করে আসছিল। এ চক্রটি কখনও দুদকের চিঠি-প্যাড ব্যবহার করে, কখনও আবার দুদকের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নোটিশ পাঠাতো। অনেকে এসব নোটিশে ভয় পেয়ে নির্ধারিত নম্বরে যোগাযোগ করে চক্রের ফাঁদে পা দিতেন।
বিশেষ করে দুদকের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তার স্বাক্ষর নকল করে মানুষকে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ প্রতারণার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। তিনি একটি ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করেন, তাঁর পরিচিত অনেকের কাছ থেকেই দুদকের পরিচয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হচ্ছে। অথচ আসল দুদকের সঙ্গে এসবের কোনো যোগসূত্র নেই।
এই অভিযোগে তৎপর হয় দুদক। শুরু করে তদন্ত ও নজরদারি। এরপর গত দুই দিনে রাজধানীর মুগদা এলাকা থেকে প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানান, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে চারজন ইতিমধ্যে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং জামিনে বের হয়ে পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়েছেন। এরা পেশাদার প্রতারক, যাদের বিরুদ্ধে আগেও মামলা হয়েছে।
তিনি বলেন, "তারা একেক সময় একেকভাবে নিজেকে দুদক কর্মকর্তা পরিচয় দেয়। অনেক সময় টার্গেট করা ব্যক্তির নামে ভুয়া তদন্ত চলছে বলে দাবি করে। আবার বলে, দুদকের নাম ক্লিয়ার করতে চাইলে ‘সমন্বয়’ করতে হবে। তারা যে ভয়ভীতি দেখায়, তাতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে।"
তবে নতুন করে নজর কেড়েছে যে বিষয়টি, সেটি হলো—প্রতারকদের ফাঁদে পা দেওয়া ভুক্তভোগীরাও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবেন। দুদক বলছে, প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি যারা অর্থ দিয়েছেন বা সুবিধা গ্রহণ করেছেন, তাদের আচরণও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, "প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দায় এড়ানো যাবে না। আমরা দেখতে চাই, তারা কতটা সচেতন ছিলেন, এবং কেন তারা এমন একটা পরিচয় যাচাই না করেই টাকা দিলেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ নিজের সুবিধা নিতে গিয়েও প্রতারণার শিকার হয়েছেন।"
তিনি জানান, এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই কয়েকজনকে ডাকা হয়েছে এবং আরও অনেককেই তলব করা হবে।
দুদক সূত্র জানায়, এই চক্রটি অনেক সময় এমনকি ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপেও পরিচয় দেয় দুদকের লোক হিসেবে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এদের টার্গেট। তারা ভয় দেখিয়ে বলে, “তদন্তে তোমার নাম এসেছে”, কিংবা “ফাইল ক্লোজ করতে হলে কিছু খরচ করতে হবে।”
এই ধরনের প্রতারণা এড়াতে দুদক জানিয়েছে, কোনো কর্মকর্তা যদি মোবাইল ফোনে কাউকে ফোন করে অর্থ দাবি করেন, তবে সঙ্গে সঙ্গেই সেটি কমিশনে জানানোর অনুরোধ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুদক মহাপরিচালক বলেন, "আমরা একটি হেল্পলাইন চালু করছি। সেই নম্বরে ফোন করে কেউ সন্দেহজনক ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবেন। পাশাপাশি যাচাই করতেও পারবেন, ফোনে যারা যোগাযোগ করেছে তারা আসলেই দুদকের কেউ কিনা।"
দুদক জানিয়েছে, ভুয়া পরিচয়ে প্রতারণা রোধে কমিশনের ভেতরে ও বাইরে কঠোর মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে। যারা দুদকের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে কমিশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার, স্কুল-কলেজ ও অফিসে সচেতনতামূলক সেমিনার আয়োজনসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে দুদক।
দুদকের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা নতুন কিছু নয়, তবে এবার যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা আগের চেয়ে ভিন্ন ও কঠোর। শুধু প্রতারক নয়, যারা এ চক্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন বা শিকার হয়েছেন, তাদেরও আইনের আওতায় এনে পুরো চিত্র উন্মোচনের চেষ্টা করছে দুদক। এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন প্রতারকদের রুখবে, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সতর্কতা বাড়াবে—এটাই প্রত্যাশা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ