
ছবি: সংগৃহীত
ইসলামি ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের একটি কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণে উদ্যোগী হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট নিরসন এবং আর্থিক ব্যবস্থায় ইসলামি ধারার আরও কার্যকর সংযুক্তির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামি মুদ্রা বাজার (Islamic Money Market) ও ইসলামি মূলধন বাজার (Islamic Capital Market) চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশের ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত “ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন”-এ এই দুইটি নতুন আর্থিক উপকরণ চালুর কথা জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এসব উপকরণ চালু করার বিষয়ে নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত হচ্ছে এবং খুব শিগগিরই তা সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।
ইসলামি ব্যাংকগুলো প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকিং নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় দেশের প্রচলিত কল মানি মার্কেট বা আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারে না। কারণ ঐ ব্যবস্থায় স্বল্পমেয়াদি ঋণ এবং আমানত আদান-প্রদানে সুদের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদ হারাম হওয়ায় তারা এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারছে না, ফলে হঠাৎ তারল্য ঘাটতি হলে সহজে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ইসলামি মুদ্রা বাজার চালু হলে শরিয়াহভিত্তিক চুক্তির আওতায় (যেমন মুদারাবা, মুশারাকা, ওয়াকালা বা ইজারা ভিত্তিক) ব্যাংকগুলো পরস্পরের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদি তহবিল ধার নিতে পারবে, যা ত্বরিত তারল্য ঘাটতি মেটাতে সহায়ক হবে। একইভাবে, ইসলামি মূলধন বাজার চালু হলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও তহবিল ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে, বিশেষত ইনফ্রাস্ট্রাকচার, এসএমই এবং সামাজিক খাতে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং খাতের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। মোট বিনিয়োগের ২৮ শতাংশেরও বেশি এখন ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ১০টি পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি শাখা রয়েছে।
তবে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই খাতের বিস্তার এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও সেবা প্রদান অত্যন্ত সীমিত, যদিও এ অঞ্চলে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকগুলোকে গ্রামমুখী ব্যাংকিং, প্রচারণা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির নির্দেশনা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য পরিপূরক অন্যান্য ইসলামি আর্থিক খাতগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে— ইসলামি পুঁজিবাজার (Islamic Capital Market): কয়েকটি শরিয়াহ কমপ্লায়েন্ট শেয়ার ও বন্ড ইতিমধ্যে চালু হয়েছে, তবে বাজারের গভীরতা ও বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ এখনও অপ্রতুল। ইসলামি বিমা বা তাকাফুল (Takaful): বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে তাকাফুল চালালেও এটি এখনো মূলধারার বিমা ব্যবস্থায় পরিণত হয়নি। ক্ষুদ্রঋণ খাত: ইসলামি ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোফাইন্যান্স মডেল অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হলেও দেশে এর বাস্তবায়ন সীমিত পরিসরে রয়েছে।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে চালু হওয়া সুকুক বন্ড (Islamic Sovereign Sukuk) একটি সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, যেমন সড়ক, ব্রিজ এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় সুকুকের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরণের বন্ড দেশের বিনিয়োগ কাঠামোকে বৈচিত্র্য এনে দিচ্ছে এবং শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, ইসলামি ব্যাংকগুলোকে ভবিষ্যতে সামাজিক ও মানবিক খাতে অধিকতর অবদান রাখতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে— কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ, মহিলা উদ্যোক্তাদের সহায়তা, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে আর্থিক সংযুক্তি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামি সামাজিক অর্থনৈতিক মডেল প্রয়োগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এই উদ্যোগ ইসলামি ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের একটি কাঙ্ক্ষিত কাঠামোগত ঘাটতি পূরণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইসলামি মুদ্রা ও মূলধন বাজার চালু হলে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো যেমন তারল্য সংকটের চাপ থেকে মুক্তি পাবে, তেমনি একটি আন্তঃব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক বাজার গড়ে উঠবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থার পরিসর বাড়ানো গেলে বাংলাদেশের ইসলামি অর্থনীতি মডেল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনুসরণযোগ্য হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ