
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান ও স্থল হামলায় আবারও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। রোববার (২৯ জুন) ভোর থেকে রাত পর্যন্ত একদিনেই নিহত হয়েছেন অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে শিশু, নারী ও বয়স্করাও রয়েছেন। নিহতদের অনেকে খাদ্য সহায়তা নিতে বিভিন্ন বিতরণকেন্দ্রে অপেক্ষা করছিলেন, যখন হঠাৎ করেই তাদের ওপর নেমে আসে ইসরাইলি বোমা ও গুলির তাণ্ডব।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে গাজা শহর এবং উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে। সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা ইতোমধ্যে ৪৭ ছাড়িয়ে গেছে। আহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি এবং অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
আল জাজিরার গাজা প্রতিনিধি মুয়াত আল-কালহুত জানান, গাজা শহরের জেইতুন, সাবরা এবং আল-জাওইয়া বাজার এলাকায় ইসরাইলি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের হামলার পর পরই আহতদের ঢল নামে আল-আহলি হাসপাতালসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে। তিনি বলেন, “হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই, ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামেরও চরম ঘাটতি রয়েছে। আহতদের অনেকেই মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকদের চোখেমুখে আতঙ্ক এবং অসহায়ত্ব স্পষ্ট।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্যুৎ সংকট ও জেনারেটরের জ্বালানি ফুরিয়ে আসায় আইসিইউ ও অপারেশন থিয়েটার কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চিকিৎসকরা সবচেয়ে গুরুতর রোগীদের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী পূর্ব গাজা শহরে লিফলেট ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, এই সতর্কতার ফাঁকেই হঠাৎ শুরু হচ্ছে তীব্র বিমান হামলা, যা একধরনের ফাঁদ হিসেবেই কাজ করছে।
আল-কালহুত জানান, “মানুষকে বলা হচ্ছে— নিরাপদে থাকতে হলে দক্ষিণে যাও। কিন্তু দক্ষিণে যাওয়ার পথে কিংবা সেখানে পৌঁছেই তারা হামলার শিকার হচ্ছেন। এই তাণ্ডব এক ভয়ংকর মানবিক ফাঁদে পরিণত হয়েছে।”
সহায়তা কেন্দ্রে হামলা: আমেরিকা ও ইসরাইলের সমর্থনপুষ্ট সংস্থার বিতরণেও রক্তাক্ত পরিণতি
রোববার নিহতদের অন্তত পাঁচজন ছিলেন রাফাহ অঞ্চলের উত্তরে একটি খাদ্য সহায়তা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষারত ফিলিস্তিনি। বিতরণ কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ), যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সরাসরি সমর্থনপুষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান।
গাজা সরকারের মিডিয়া অফিসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মে মাসের শেষদিক থেকে জিএইচএফ আংশিক সহায়তা বিতরণ কার্যক্রম শুরু করলেও এর আওতাধীন কেন্দ্রগুলোর আশপাশে হামলার ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ইসরাইলি সেনারা প্রায়শই এসব এলাকায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে কিংবা ছোট আকারের বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে।
এই সহায়তা কেন্দ্রগুলোর আশপাশে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে গত এক মাসেই নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৮০ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন আরও চার হাজারের বেশি মানুষ। নিহতদের অনেকেই ছিলেন নারী ও শিশু, যাদের অধিকাংশ সহায়তা নিতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন।
গাজায় বর্তমান পরিস্থিতি শুধু বোমা ও গুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে মানবিক সংকটও। দীর্ঘদিনের অবরোধ ও চলমান যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও চিকিৎসার ঘাটতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, উপত্যকায় এখন প্রতিদিনই শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। নবজাতক ও দুগ্ধপানকারী শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সম্প্রতি পাওয়া একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই গড়ে ১০-১২ জন শিশু মারা যাচ্ছে।
একজন মানবাধিকার পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, “খাদ্য নেই, পানীয় জলের সংকট, চিকিৎসা নেই, আর প্রতিনিয়ত চলছে বোমাবর্ষণ। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
গাজায় চলমান হামলা এবং সহায়তা কেন্দ্রে আক্রমণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলেও বড় কোনো দেশের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান প্রতিবাদ বা কার্যকর হস্তক্ষেপ এখনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ ও কিছু ইউরোপীয় সংস্থা মাঝে মাঝে উদ্বেগ জানালেও তা হামলা থামানোর জন্য যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারছে না।
ফিলিস্তিনপন্থি সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, ইসরাইল মার্কিন সমর্থন পাওয়ার সুযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে উপেক্ষা করেই সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
এক দিনের হামলায় আরও ৭২ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু শুধুই একটি পরিসংখ্যান নয়; এটি গাজার লাখো মানুষকে অনিশ্চয়তা, শোক এবং ক্ষোভের মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছে। প্রতিদিনের বোমা, ক্ষুধা এবং অসহায়ত্ব মিলিয়ে এই উপত্যকাটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন এক মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংকটের সমাধান প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ