
ছবি: সংগৃহীত
চলমান টানাপোড়েন, অচলাবস্থা ও সরকারের চাপের মুখে অবশেষে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে চলা এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পরিষদের মহাসচিব সেহেলা সিদ্দিকা। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি। তবে আলোচনার পথ খোলা রয়েছে।”
এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এলো, যখন এনবিআরের কর্মবিরতির কারণে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছিল এবং সরকারও কড়া অবস্থান নিচ্ছিল। পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
ব্যবসায়ীরা শুরু থেকেই এনবিআরের কর্মকর্তাদের “কমপ্লিট শাটডাউন” কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছিলেন। এই কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেই চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। গতকাল শনিবার সকাল থেকেই বন্দরের কনটেইনার ডেলিভারির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়, যদিও তখনও পূর্ণাঙ্গ শাটডাউন কার্যকর হয়নি। বন্দরের ব্যবহারকারীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই ৪০ হাজারের বেশি কনটেইনার জমে যেতে পারে, যা দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারত।
চট্টগ্রামের পাশাপাশি বেনাপোল স্থলবন্দরেও এই অচলাবস্থা দেখা দেয়। মাত্র দুই দিনেই সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা আসে এবং নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে ফেলে দেয়।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোববার এক গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এনবিআরের আওতাধীন সব ধরনের চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা’ হিসেবে ঘোষণা করে। সরকার জানায়, জাতীয় স্বার্থে, বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য ও জরুরি আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ঘোষণার ফলে কাস্টমস হাউস, ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি), বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনসমূহের কর্মচারীরা ধর্মঘটে গেলে তা হবে আইনবহির্ভূত।
আইন অনুযায়ী, এই সেবা ঘোষণার মেয়াদ হবে ৬ মাস। প্রয়োজন হলে সরকার তা গেজেটের মাধ্যমে ৬ মাস করে বাড়াতে পারবে।
‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন ১৯৫৮’-এর অধীনে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ বা কর্মবিরতি ডাকার ফলে কর্মীদের জন্য শাস্তির বিধানও রয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, কর্মীরা যদি ধর্মঘটে যান বা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তবে তাদের সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে, যার মধ্যে চাকরিচ্যুতির মতো কঠিন সিদ্ধান্তও অন্তর্ভুক্ত।
একই সময়, আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা এনবিআরের উচ্চপদস্থ ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ রোববার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানান, “এনবিআরের ৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অবৈধ সুবিধা প্রদানের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।”
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন স্টেশনে দায়িত্ব পালনকালে তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন এবং রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন। এই দুর্নীতির মাধ্যমে তারা আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক আদায়ে ছাড় দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ৬ জন কর্মকর্তার তালিকায় রয়েছেন—
১. এ কে এম বদিউল আলম, সদস্য (আয়কর নীতি বিভাগ)
২. হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, অতিরিক্ত কমিশনার (নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর) ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি
৩. মির্জা আশিক রানা, অতিরিক্ত কমিশনার (ঢাকা-৮ কর অঞ্চল), পরিষদের সহসভাপতি
৪. শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কর কমিশনার (কর অঞ্চল-১৬), পরিষদের সহসভাপতি
৫. সাধন কুমার কণ্ডু, অতিরিক্ত কমিশনার (ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট)
৬. মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, যুগ্ম কর কমিশনার (বিএসএস কর একাডেমি)
তাদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলছে যে, তারা নিজেদের এবং সংশ্লিষ্টদের লাভবান করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক ফাঁকি, ভ্যাট ছাড় ও কর পরিহারের সুযোগ দিয়েছেন।
যদিও এনবিআরের কর্মকর্তারা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন, তবুও দুর্নীতির অনুসন্ধান এবং চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা’ ঘোষণার ফলে প্রশাসনিক চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এনবিআর সংস্কার, কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস এবং প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলা—এই তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এখন সরকারের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
অন্যদিকে, এনবিআরের কর্মকর্তারা কীভাবে এই চাপের মধ্যে তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন বা ভবিষ্যতে আবারও আন্দোলনে ফিরবেন কি না, সেটিও দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ