
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার এবং আয় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জটিল এক সংকট পার করছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক সরাসরি সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে এনবিআরের রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনাকে পৃথকীকরণের সরকারি সিদ্ধান্তকে ঘিরে কর কর্মকর্তাদের চলমান আন্দোলনের ফলে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে আইএমএফ। এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকও এ খাতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা চলমান সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।
রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান আইএমএফ-এর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন মিশনের ডেপুটি প্রধান আইভো ক্রিজনার এবং ঢাকাস্থ আইএমএফ-এর আবাসিক প্রতিনিধি জয়েন্দু দে।
পাপাজর্জিও বলেন, “এনবিআর চেয়ারম্যান আমাদের নিয়মিত আপডেট দিচ্ছেন। রাজস্ব আদায় ও কাঠামোগত সংস্কারের যে কার্যক্রম চলছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের যে চেষ্টা চলছে, সেটি শুধু আইএমএফ-এর জন্য নয়, দেশের মানুষের স্বার্থেই। এটি জনগণকেও স্বীকৃতি দিতে হবে যে, এই সংস্কারগুলো জরুরি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করতে কার্যকর।”
আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং কর প্রশাসনের ব্যবস্থাপনাকে দুই ভাগে ভাগ করার সুপারিশ করে আসছে। এই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ইতোমধ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করে আলাদা দুটি ইউনিট গঠনের উদ্যোগ নেয়। তবে এনবিআরের কর কর্মকর্তারা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি হলো এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ।
এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে আইএমএফ-এর শর্ত মোতাবেক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ মিশনপ্রধান বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। এই সময়ে কিছু ভূরাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে আমরা মনে করি, সময়মতো নির্বাচন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “আইএমএফ কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। তবে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক পরিবেশে স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রাজনৈতিক সময়সূচি ঠিক হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন। নির্বাচনের সময় ঘোষণা হওয়ার ফলে এখন সে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।”
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকও এনবিআরের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে নিয়মিত পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত রয়েছে এবং সংস্থাটি আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে জানানো হয়, রাজস্ব খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করতে তারা প্রযুক্তিগত সহায়তা, পরামর্শ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা করতে চায়।
আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের কর আদায় সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ হার এখনো ৯ শতাংশের নিচে, যেখানে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এই হার ১৫ শতাংশের ওপরে থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এনবিআরের বর্তমান কাঠামো সংস্কার এবং ডিজিটালাইজেশন অত্যন্ত জরুরি।
মিশনপ্রধান আরও বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চ্যালেঞ্জিং এক সময় অতিক্রম করছে। রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয়, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর সমন্বিত চাপ পড়ছে। এর মাঝে যদি কর কাঠামোর সংস্কার সফল হয়, তবে অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী হবে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে এনবিআরের চলমান সঙ্কট শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর নয়, দেশের বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবাহেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এ অবস্থায় আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সম্মিলিত সহায়তা রাজস্ব কাঠামোর আধুনিকীকরণে ইতিবাচক অবদান রাখবে বলেই প্রত্যাশা করছে অর্থনীতিবিদরা। তবে একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্থিরতা নিরসন না হলে এসব উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনবে কি না, সেই প্রশ্নও থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে