
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনা চলছিল। বিশেষ করে ২০২৩ সালের গণ-আন্দোলন ও এর পরবর্তী রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকে ঘিরে জাতিসংঘের আগ্রহ বাড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় অবশেষে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (OHCHR) একটি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
রোববার (২৯ জুন) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ’র খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
বৈঠক শেষে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের সঙ্গে আমাদের সরকারের দীর্ঘদিনের আলোচনা চলছিল। তারা একটি পূর্ণাঙ্গ মিশনের আওতায় বাংলাদেশে একটি শাখা খুলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা সেই আলোচনায় ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “আজকের বৈঠকে এই বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা কয়েকজন উপদেষ্টা মিলে খসড়া পরীক্ষা করব এবং তা চূড়ান্ত করে জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরে পাঠানো হবে। এরপরই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে।”
আইন উপদেষ্টা আরও জানান, ঢাকায় জাতিসংঘের এই মানবাধিকার কার্যালয় প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। “তিন বছর মেয়াদ শেষে দুই পক্ষ যদি সন্তুষ্ট থাকে এবং উভয় পক্ষের সম্মতিতে এটি নবায়ন প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয়, তাহলে পরবর্তী মেয়াদের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে,” বলেন আসিফ নজরুল।
এটি জাতিসংঘের OHCHR-এর একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে কাজ করবে। এখানে মানবাধিকার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ, নীতি পর্যালোচনা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এছাড়াও এটি দেশের সরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে মানবাধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে।
কার্যালয়টির কাজের আওতায় থাকবে— মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ, সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা, সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবাধিকার নীতির উন্নয়নে পরামর্শ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির একটি আন্তর্জাতিক রেফারেন্স পয়েন্ট সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের এ ধরনের কার্যালয় স্থাপন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মানবাধিকার চর্চা এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতি প্রতিশ্রুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বলেই বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি রাজনৈতিক আন্দোলন, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা, নিখোঁজ-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ইস্যুতে দেশ ও বিদেশের অনেক মানবাধিকার সংগঠন উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল।
জাতিসংঘের এই উপস্থিতি দেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ জোরদার করবে এবং ভবিষ্যৎ সরকারকে দায়িত্বশীল আচরণে উৎসাহিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ), ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “জাতিসংঘের এ ধরনের কার্যালয় বাংলাদেশে একটি ইতিবাচক মাইলফলক হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চর্চার মধ্যে একটি কার্যকর সেতুবন্ধন গড়ে উঠবে।”
বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত কয়েকজন সদস্য খুব শিগগিরই খসড়া সমঝোতা স্মারকের ভাষা ও কাঠামো পুনরায় পর্যালোচনা করবেন। এরপর তা জাতিসংঘের হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের কাছে পাঠানো হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে ঢাকায় কার্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এবং সম্ভাবনার দ্বার। এখন দেখার বিষয়, এই কার্যালয় কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং বাংলাদেশে মানবাধিকারের মানোন্নয়নে কতটা বাস্তব ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ