
ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক ব্যবসা একটি বিপ্লবী ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হলেও সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন কেবল একটি ধারণা নয়, বরং বৈশ্বিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোকে মানবকল্যাণ ও পরিবেশবান্ধব ভিত্তির ওপর পুনর্গঠন করার এখনই সময়, আর সে কাজে সামাজিক ব্যবসা হতে পারে অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার।
রোববার (২৯ জুন) রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভিডিও বার্তায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (NSU) এবং ইউনূস সেন্টার যৌথভাবে আয়োজন করে ‘সোশ্যাল বিজনেস একাডেমিয়া ডায়ালগ ২০২৫’ ও ‘থ্রি জিরোস ক্লাব কনভেনশন’, যা সামাজিক ব্যবসা, মানবিক অর্থনীতি এবং টেকসই উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে আয়োজন করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, “এই সম্মেলন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিক্ষক, গবেষক, শিল্পপতি এবং শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা তিনটি শূন্য— শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ— এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করছি। এটি কেবল স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবায়নযোগ্য একটি কাঠামো।”
তাঁর মতে, “বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়। এটি এমন এক কাঠামো, যা কেবল ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য তৈরি। কিন্তু আমরা চাই এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে মুনাফার চেয়ে মানবিকতা ও পরিবেশবান্ধব চিন্তাভাবনার গুরুত্ব বেশি থাকবে।”
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম তাঁর বক্তব্যে বলেন, “টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের অবশ্যই থ্রি জিরো মডেলের বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে। প্রচলিত মুনাফাকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দরকার মানবিক কল্যাণ, পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার সমন্বয়।”
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, “সামাজিক ব্যবসা আমাদের শেখায় কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এ ধরনের ব্যবসায় মুনাফা কেবল শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সমাজে ফিরে যায়। এটি মূলধারার ব্যবসার তুলনায় অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক।”
বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং নিজামী গঞ্জাভি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের কো-চেয়ার ইসমাইল সেরাগেলদিন বলেন, “শুধু জ্ঞান অর্জন যথেষ্ট নয়, বরং দরকার প্রজ্ঞা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ছাত্ররা সৃজনশীলতা, নৈতিকতা ও সহানুভূতির শিক্ষা পায়।”
অন্যদিকে, নরওয়ের পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী এবং ইউএন এনভায়রনমেন্টের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এরিক সোলহেইম বলেন, “এখন মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা এমন একটি স্তরে পৌঁছেছি, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা একসঙ্গে সম্ভব। বাংলাদেশ এই ভারসাম্য রক্ষায় নেতৃত্ব দিতে পারে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফয়েজ বলেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজকে হতে হবে মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক। এজন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সামাজিক ব্যবসার ধারণা আমাদের সেই পথে নিয়ে যেতে পারে।”
এছাড়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এবং সিটি ব্যাংক পিএলসি’র চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার বলেন, “বিশ্ব এখন নজিরবিহীন জটিলতায় ভরা। তরুণরাই হবেন নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্থপতি। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যৎ গড়ার একটি মানবিক পথ পাবে।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী। তিনি বলেন, “আমাদের দায়িত্ব শুধু ডিগ্রি দেওয়া নয়, বরং এমন নাগরিক গড়ে তোলা যারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।”
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এনএসইউর অ্যাকাউন্টিং ও ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক এফ জে মোহাইমেন এবং ইংরেজি ও আধুনিক ভাষা বিভাগের চেয়ারম্যান নাজিয়া মানজুর।
গাজীপুর থেকে গাজা পর্যন্ত এবং গ্লোবাল দক্ষিণ থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার প্রশাসক পর্যন্ত এই সম্মেলনে উঠে এসেছে একটি সমন্বিত বার্তা— ব্যবসার মূল লক্ষ্য এখন আর কেবল মুনাফা নয়, বরং তা হতে হবে মানবিক কল্যাণ, পরিবেশের ভারসাম্য এবং সামাজিক ন্যায়ের সমন্বয়।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সামাজিক ব্যবসা এখন আর তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং বাস্তব ও প্রয়োগযোগ্য এক আন্তর্জাতিক আন্দোলন, যা পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সমাজে। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে মানবিক অর্থনীতির বিশ্বদরবারে নেতৃত্ব নেওয়ার লক্ষ্যে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ