
ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধির খসড়া সংশোধনী প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সর্বশেষ এই খসড়ায় রাজনৈতিক প্রচারণার পদ্ধতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নিয়ম-কানুন থেকে শুরু করে পরিবেশবান্ধব প্রচারসামগ্রী ব্যবহারের নির্দেশনা, প্রচারের শব্দসীমা নিয়ন্ত্রণ, আইনি পদক্ষেপ ও জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রোববার (২৯ জুন) সন্ধ্যায় ইসির নিজস্ব ওয়েবসাইটে এই খসড়া প্রকাশ করা হয়। এর ওপর মতামত দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ জানিয়েছেন, এটি শুধু রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের জন্য খোলা মতামত প্রদানের সুযোগ। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সর্বস্তরের নাগরিক ও অংশীজনের মতামত গ্রহণের একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে চায়।
প্রকাশিত খসড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো— সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারণার সুযোগ রাখা হলেও সেখানে ঘৃণামূলক বক্তব্য, বানোয়াট তথ্য, ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো কনটেন্ট ছড়ানো হলে তা সাইবার সুরক্ষা আইনে দণ্ডনীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইসি জানায়, প্রচারের সময়সীমার মধ্যে প্রার্থী বা তাদের নির্বাচনি এজেন্ট বা অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে পারবেন, তবে এই প্রচারণা শুরুর আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অ্যাকাউন্টের নাম, আইডি, ই-মেইলসহ প্রয়োজনীয় সনাক্তকরণ তথ্য জমা দিতে হবে।
এ উদ্যোগের মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নির্বাচনি শৃঙ্খলা রক্ষায় কমিশনের মনোযোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রস্তাবিত আচরণবিধিতে প্রচার-প্রচারণার ধরনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো— পোস্টার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রচারে ব্যবহার করা যাবে লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিল ও বিলবোর্ড। তবে রেক্সিন ও প্লাস্টিকের মতো অপচনশীল দ্রব্য দিয়ে তৈরি প্রচারসামগ্রী ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই নির্দেশনার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রোধের পাশাপাশি প্রচার উপকরণের নির্ধারিত নীতিমালাও কঠোরভাবে প্রয়োগ করার ইঙ্গিত দিয়েছে কমিশন।
প্রচারণায় শব্দ দূষণ রোধে মাইকের শব্দসীমা ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
একইসঙ্গে, অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাকে ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের নির্বাচনি প্রচারে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থাটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা রক্ষার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে বলে ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নতুন খসড়ায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
এখন থেকে কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাদের ১.৫ লাখ টাকা (দেড় লাখ) পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। প্রার্থী বা তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে আগের মতোই ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান থাকছে।
এছাড়া প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার জন্য আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা নির্বাচন কমিশনের কাছে সংরক্ষিত থাকবে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, অতীতে খসড়া আচরণবিধি শুধুমাত্র নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে মতামত নেওয়া হতো। কিন্তু এবারের নির্বাচন কমিশন প্রথমবারের মতো ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ফলে দেশের সাধারণ নাগরিক, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, শিক্ষাবিদ, গবেষক কিংবা সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তি এই খসড়ার ওপর মতামত দিতে পারবেন।
এই অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশন একটি জনমুখী, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পরিচালনার অঙ্গীকার আবারও দৃঢ় করল।
আচরণবিধির খসড়া প্রকাশ এবং মতামত আহ্বানের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিগত দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারপ্রক্রিয়া, আচরণগত শৃঙ্খলা ও প্রচারের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নির্বাচন প্রচারের ক্ষেত্রে নতুন বিধিনিষেধ, পরিবেশবান্ধব প্রচারসামগ্রী ব্যবহারের নির্দেশনা, উচ্চমাত্রার শব্দ নিয়ন্ত্রণ এবং কঠোর আর্থিক জরিমানার বিধান— এসবই নতুন মাত্রার নির্বাচনি বিধিনিষেধ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে।
সব মিলিয়ে এই খসড়া একটি নীতিগত ও কাঠামোগত উন্নয়ন হলেও, বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করবে এর বাস্তবায়ন ও নির্বাচনি মাঠে সংশ্লিষ্টদের আচরণের ওপর। এখন অপেক্ষা— ১০ জুলাইয়ের মধ্যে কতটা ফলপ্রসূ মতামত আসে এবং কমিশন তা কতটা আমলে নেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ