
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ দেড় মাসের আন্দোলনের অবসান ঘটিয়ে আবারও চেনা ছন্দে ফিরছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর্মসূচি প্রত্যাহারের পরদিনই সোমবার (৩০ জুন) আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাকে অতীত ভুলে দেশের স্বার্থে সর্বোচ্চ নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “যা কিছু হয়েছে, সব কিছু ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমরা সবাই কাজ করবো। যে কাজগুলো আছে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবো। আশা করি, ভবিষ্যতে এনবিআরকে আর এমন বড় ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না।”
এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সদ্য সমাপ্ত আন্দোলনের রেশ কাটিয়ে রাজস্ব প্রশাসনকে নতুন উদ্যমে মাঠে নামার বার্তা দেন। এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, অতীতের মতো সবাই দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন।”
উল্লেখ্য, এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ সংশোধনসহ চার দফা দাবিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে দেড় মাস ধরে চলা কলম বিরতি, অবস্থান কর্মসূচি, কমপ্লিট শাটডাউন ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ আন্দোলন রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ফলে রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা তৈরি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে ছন্দপতন ঘটে এবং সরকারের রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা বাড়ে। তবে রোববার (২৯ জুন) সন্ধ্যায় আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এক অনিশ্চয়তার ইতি টানে এনবিআর কর্মকর্তারা।
এনবিআর চেয়ারম্যান মতবিনিময়কালে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের প্রাথমিক চিত্র তুলে ধরে জানান, “আজ (৩০ জুন) সকাল ১০টা পর্যন্ত আমাদের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।”
তিনি বলেন, “গতবারের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেশি হবে এটা নিশ্চিত। তবে যে হারে আদায় হবে বলে আমরা শুরুতে আশা করেছিলাম, গত কয়েক দিনের অচলাবস্থায় তার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে। তারপরেও আজকের দিনটিকে কাজে লাগিয়ে আমরা ট্রেজারিতে আরও বড় অঙ্ক জমা করার চেষ্টা করছি।”
তিনি আরও জানান, “কাস্টমস হাউজগুলো গতকাল বিকাল থেকেই কাজ শুরু করেছে। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর আজ সকাল থেকেই সব দপ্তরে সম্পূর্ণ উপস্থিতি আছে। কাস্টমস, ভ্যাট, কর অফিস—সবাই এখন কাজে ব্যস্ত।”
রাজস্ব আদায়ের এই বাড়তি তৎপরতা যে সরকারের সামনের মাসের খরচ মেটাতে জরুরি, সেটিও স্পষ্ট করে তুলে ধরেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “জুলাই মাসে সরকারের ব্যয় অনেক বেশি থাকে। এ সময় সরকারি কর্মচারীদের বেতন, বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন বাজেট ছাড়, ও বিভিন্ন ভর্তুকি বিল পরিশোধের বিষয় থাকে। সেই প্রয়োজন মেটাতে আমরা জুলাই মাসেও রাজস্ব ড্রাইভ চালিয়ে যাবো।”
চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, “আজ আমাদের বড় ড্রাইভ থাকে। রেভিনিউগুলো যেগুলো পাইপলাইনে আছে, সেগুলো ট্রেজারিতে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ব্যাংক খোলা, অফিস খোলা—সবাই কাজ করছে। আমরা আমাদের সব রিসোর্স ব্যবহার করছি। আমার ধারণা, আজ ভালো অঙ্কের অর্থ জমা হবে।”
আধুনিক রেভিনিউ রিপোর্টিং ব্যবস্থার প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা এখন আর ম্যানুয়াল রিপোর্ট করি না। আইবাস প্ল্যাটফর্মে আমাদের আদায়ের রিপোর্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে। এখন এনবিআর একটি ফিগার বলবে, বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটি বলবে—এমন বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। এখন সবাই একই ফিগার বলছে।”
তিনি বলেন, “এই স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতিই আমাদের রেভিনিউ প্রশাসনে স্থায়িত্ব ও নির্ভরযোগ্যতা ফিরিয়ে এনেছে। আমাদের লক্ষ্য, এই কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা পরে কিছুটা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব ঘাটতির শঙ্কা এখনো রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চলতি অর্থবছরে কেবল এনবিআরের রাজস্ব আদায় ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা দেশের রাজস্ব ইতিহাসে রেকর্ড ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এনবিআর চেয়ারম্যান নিজেও স্বীকার করেছেন যে আন্দোলন ও প্রশাসনিক স্থবিরতার কারণে রাজস্ব আদায় কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। তবে তিনি আশাবাদী যে জুলাইয়ে অতিরিক্ত সংগ্রহ দিয়ে ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
চলমান পরিস্থিতিতে এনবিআর চেয়ারম্যান সকল কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে বলেন, “আমাদের অতীতের যেসব বিভ্রান্তি ও অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা ছিল, সেগুলোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু নেই। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা আজ আছি, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি আশা করি, এনবিআরের প্রত্যেক কর্মকর্তা পূর্বের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের আলোকে কাজ করবেন এবং আগামী বাজেট বাস্তবায়নে আরও বেশি অবদান রাখবেন।”
দীর্ঘ আন্দোলনের পর একসঙ্গে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার জন্য যে সংহতি প্রয়োজন, এনবিআর চেয়ারম্যানের আহ্বান তাতে তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী দিনে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা জোগাড় করতে হলে রাজস্ব প্রশাসনকে সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতায় ফিরে যেতে হবে।
এই বাস্তবতায় এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহ শুধু একটি সংস্থার দায়িত্ব নয়, বরং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার সর্বজনীন প্রয়াসের অংশ। এখন দেখার বিষয়, আন্দোলনের ক্ষত কাটিয়ে এনবিআর কত দ্রুত পূর্ণ কর্মতৎপরতা ও আস্থা ফিরে পেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে