
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে আবারও বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বর্ষা মৌসুমে মশাবাহিত এই রোগের সংক্রমণ প্রতিদিনই উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৪২৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪২ জন, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৮০ শতাংশ।
সোমবার (৩০ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা ঢাকার চেয়ে অনেক বেশি। এটি ডেঙ্গুর ভূগোলগত বিস্তৃতির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাজধানী কেন্দ্রিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর, জেলা সদর ও গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
গত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সাধারণত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও এবার সংক্রমণ অনেক বেশি ছড়িয়েছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ প্রস্তুতি ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর এখন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৯৬ জনে। এর মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ৮৫ জন এবং নারী ৪ হাজার ২১১ জন।
বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিস্তার অপেক্ষাকৃত নিয়ন্ত্রিত থাকলেও জুনের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণের হার দ্রুত বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই মশার প্রজনন ক্ষেত্র বাড়ায় রোগের বিস্তারও গতি পেয়েছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ এবং ১৯ জন নারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার কম হলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া, রোগ শনাক্তে বিলম্ব এবং জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় অনেক রোগীর প্রাণহানি ঘটে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় আধুনিক চিকিৎসাসুবিধা নেই, সেসব জায়গায় মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকতে আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। অতিরিক্ত জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, শরীরে দাগ বা র্যাশ—এগুলো ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ।
যেসব এলাকায় আগে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম ছিল, সেসব এলাকাতেও এবার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনগুলোকে মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু রোধে শুধু হাসপাতাল নির্ভরতা যথেষ্ট নয়। সামগ্রিকভাবে শহর, নগর ও গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ পরিছন্ন রাখতে হবে। জমে থাকা পানি, ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, পরিত্যক্ত টায়ার বা কন্টেইনারে যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতোমধ্যে জানিয়েছে, আগামী কয়েক সপ্তাহে বৃষ্টিপাত আরও বাড়তে পারে, যা এডিস মশার বিস্তারে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে। ফলে ডেঙ্গুর বিস্তারও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। একদিনে ৪০০ জনের বেশি আক্রান্ত হওয়া এবং এখন পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু ডেঙ্গু মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংক্রমণ রোধ সম্ভব নয়।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রতিরোধে দ্রুত মশক নিধন কর্মসূচি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং সচেতনতা কার্যক্রম চালানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। নয়তো আসন্ন জুলাই ও আগস্টে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ