
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অস্থিরতা, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন এবং সরকার গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের একদিনে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলার ঘটনাপ্রবাহে নতুন করে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, একদিকে যখন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত অচল হয়ে পড়ে এবং রাজস্ব আদায়ের প্রধান সংস্থাটি যখন ইতিহাসের অন্যতম বড় অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে, তখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরপর দুইদিন ভিন্নমুখী বার্তা—অনেকের কাছে এটিকে নীতি-সংকট এবং সমন্বয়হীনতার নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আয়োজিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স অফিসগুলোয় কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, পণ্য খালাস, রাজস্ব আদায় ও শিল্প কারখানার কাঁচামাল সরবরাহে। পুরো পরিস্থিতির চাপ গিয়ে পড়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ওপর। এই পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (২৯ জুন) এক জরুরি বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা করা এবং সংকট নিরসনে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠন।
এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা। বৈঠকে একমত হয়ে বলা হয়, এনবিআরের চলমান সংস্কার আন্দোলনের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় নির্ধারণ করাই হবে এই কমিটির প্রধান দায়িত্ব। বৈঠকের শেষে এসব সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
কিন্তু ঠিক পরদিন, সোমবার (৩০ জুন), একই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা গেজেট নোটিফিকেশনে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্নরকম চিত্র। সেই গেজেটে কমিটি গঠনের কথা থাকলেও, কমিটির কার্যপরিধি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত। গেজেটে বলা হয়, নতুন গঠিত উপদেষ্টা কমিটি দেশের ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, বন্দর ও রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে এবং এসব কার্যক্রম আরও গতিশীল করার সুপারিশ প্রদান করবে। অথচ রোববারের উপদেষ্টা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল এনবিআরের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সংস্কার নিয়ে অসন্তোষ, কর্মকর্তাদের আন্দোলনের পেছনে কী কারণ রয়েছে এবং কীভাবে তা সমাধান করা যায়—সে বিষয়ে সুপারিশ করা।
এই ফারাকই তৈরি করেছে বিতর্ক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরপর দুই দিনের সিদ্ধান্তের মধ্যে এমন তফাত দেখে কেউ কেউ বলছেন, এটি রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক ‘চাপের’ ফল, যার কারণে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা—যারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকতে চান—তারা বলেছেন, উপদেষ্টা পরিষদের রোববারের বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছিল বেশ সুনির্দিষ্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে চলমান অচলাবস্থা নিরসনের একটা পথ তৈরি হতে পারত। কিন্তু পরদিন যে গেজেট প্রকাশ করা হলো, সেখানে কার্যপরিধির এমন পরিবর্তন দেখে তারা বিস্মিত।
তাদের ভাষ্য, এই কমিটি এনবিআরের সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে সরাসরি কিছুই বলবে না বা কোনো কার্যকর সমাধান দেবে না বলেই মনে হচ্ছে। বরং এভাবে বিষয়টিকে সাধারণ পর্যালোচনা পর্যায়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে মূল সংকট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এনবিআরের একজন অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, “আমরা রাষ্ট্রবিরোধী কেউ নই। বরং আমরাই চাচ্ছি প্রকৃত সংস্কার হোক। কিন্তু আমাদের যৌক্তিক দাবি ও আন্দোলনকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে আমাদের ‘সংস্কারবিরোধী’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, এনবিআর কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ প্রকৃতপক্ষে চায়—কর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সিস্টেম আপগ্রেডেশন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠুক। “আমরা আন্দোলন করছি সঠিক সংস্কারের জন্য, কেবল ব্যক্তি-ভিত্তিক ক্ষমতার দখলের বিরুদ্ধে নয়,”—বলেন ওই কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে একদিনের ব্যবধানে উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলার ঘটনা সরকারের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের ঘাটতির প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে, যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে তার ছায়া পড়ে, তখন দ্রুত, সুসমন্বিত ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে বিভ্রান্তিকর সংকেত দেওয়া পুরো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
একজন সাবেক সচিব বলেন, “প্রথমে এনবিআরকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হলো, সংকট সমাধানের জন্য কমিটি গঠন করা হলো, পরদিন সেই কমিটিই নতুন চরিত্র পেল। এর মানে দাঁড়ায়, হয় সরকারের ভিতরে দ্বিমত রয়েছে, না হয় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য বাইরে থেকে চাপ এসেছে।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের রাজস্ব আয়ের প্রাণকেন্দ্র। এই সংস্থার কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়লে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ধস নামে। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সংস্কার বা নেতৃত্বসংক্রান্ত সংকটকে এড়িয়ে গিয়ে সংকট সমাধানের পথ খোঁজা আত্মঘাতী হতে পারে। সরকারের উচিত হবে স্পষ্ট, সময়োপযোগী এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে একটি সমন্বিত সমাধান খুঁজে বের করা—যেটি রাজস্ব কর্মকর্তাদের উদ্বেগ যেমন দূর করবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিকেও স্থিতিশীল রাখবে। বিভ্রান্তিকর গেজেট নয়, দরকার সাহসী ও সৎ পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এসজে