
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আগামী পাঁচ বছরে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই ভয়াবহ সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে একটি বিস্তৃত গবেষণা প্রতিবেদন। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই সংখ্যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশু, যারা পাঁচ বছরের নিচে।
গবেষণার এই ফলাফল সামনে এসেছে এমন সময়ে যখন স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে জাতিসংঘের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আলোচনা হবে। এই গবেষণার মাধ্যমে একটি উদ্বেগজনক বার্তা উঠে এসেছে যা বিশ্বনেতাদের জন্য হুঁশিয়ারি স্বরূপ।
গবেষণায় জানানো হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি বিশ্বব্যাপী মানবিক তহবিলের প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করতো। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। বিশেষ করে, তার এক ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা যিনি ব্যবসায়িক দুনিয়ায় ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছেন, সগর্বে ইউএসএআইডি বন্ধ করার ঘোষণা দেন।
এই কারণে ১৩৩টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক গবেষক দল মডেলিং পদ্ধতিতে অনুমান করেছে, অর্থ সহায়তা কমে যাওয়ার ফলে আগামী দশকের মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য ছিল। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫ লাখেরও বেশি হতে পারে। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশু মারা যেতে পারে।
গবেষণাপত্রের সহ-লেখক, বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথের (আইএসগ্লোবাল) বিশিষ্ট গবেষক ডেভিড রাসেল্লা বলেন, "গত দুই দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইউএসএআইডির অর্থায়নে যে স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, তা এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই পরিবর্তনকে একটি মহামারীর মতো ভাবা যেতে পারে।"
২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইউএসএআইডি ৯ কোটি ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু রোধে কাজ করেছে, যা স্বাস্থ্যখাতে এক বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এই সহায়তা হ্রাসের ফলে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যাপকভাবে খারাপ হবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই গবেষণার প্রকাশনার সাথে সাথে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মানবিক সহায়তা পুনঃসূচনা ও বর্ধিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে, স্পেনের আসন্ন সম্মেলনে এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনার বিষয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে, সেটি যদি বজায় না থাকে, তাহলে বৈশ্বিক মৃত্যুহার বাড়ার পাশাপাশি শিশু মৃত্যুর হারও ক্রমাগত বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতি বিশ্বের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়।
গবেষকরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই সম্ভাব্য মৃত্যু সংখ্যার মাত্রা এত বড় যে তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চার বছরে প্রায় এক কোটি প্রাণহানির সমান। অর্থাৎ, একের পর এক প্রাণহানি ঘটার ঘটনাকে বিশ্ব ইতিহাসে একটি বড় মানবিক বিপর্যয়ের মতো দেখা যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মত বড় একটি দেশের অবদান হ্রাস পেলে তা দারিদ্র্য ও অসুস্থতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বড় ধাক্কা হিসেবে প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা দ্রুত এই সংকট মোকাবেলা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসার ওপর জোর দিচ্ছেন।
মানবিক সহায়তার মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ না হলে, ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত আরও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, যা গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটির জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে। তাই বিশ্বনেতাদের সামনে এখন একটি জরুরি চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়েছে, তা হলো মানবিক ও স্বাস্থ্য সহায়তা পুনরায় শক্তিশালী করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন রক্ষা করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ