
ছবি: সংগৃহীত
আজ ১ জুলাই, ২০২৫; এক বছর পূর্ণ হলো সেই ঐতিহাসিক জুলাই গণ অভ্যুত্থানের যাত্রার, যার সূত্রপাত হয়েছিল ২০২৪ সালের এই দিনে। তখন ঢাকার প্রধান পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)—সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ‘কোটা নয়, মেধা চাই’—এই স্লোগানকে সামনে রেখে ছাত্ররা উত্তাল হয়ে ওঠে এবং তাদের এই সংগ্রাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই আন্দোলনের পেছনে ছিল তরুণ প্রজন্মের মেধা ও অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষা।
তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই ৩৬ দিন পর্যন্ত চলা বৃহৎ গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার কার্যক্রম ২০১৮ সালে বাতিলের পর ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট তার সেই আদেশ বাতিল করে পুনর্বহাল করে। এই রায়কে কেন্দ্র করে কোটা পুনর্বহাল বিরোধী ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং নতুন করে আন্দোলন শুরুর প্রস্তুতি নেয়।
জুলাইয়ের প্রথম দিনে ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়, যা কলাভবন, শ্যাডো, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ এবং বিভিন্ন হলে ছড়িয়ে পরে। মিছিলের গন্তব্য ছিল রাজু ভাস্কর্য, যেখানে চার দফা দাবি উত্থাপিত হয়। এই দাবিগুলো ছিল: ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের আদেশ বহাল রাখা, কোটা পদ্ধতির সংস্কার করে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা, সরকারের সর্বস্তরের কোটা পদ্ধতির অযৌক্তিকতা দূরীকরণ, অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য সংবিধান অনুযায়ী সীমিত কোটার ব্যবস্থা।
দাবি আদায় না হলে আন্দোলন জোরদার করার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরপরই ২ জুলাই গণপদযাত্রা এবং ৪ জুলাই পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা আসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা দিনভর বিক্ষোভ চালিয়ে জাতীয় কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত থাকে। তারা কোটা পুনর্বহালের আদেশ বাতিল না হলে লাগাতার আন্দোলনের ডাক দেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বৃষ্টির মধ্যে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করে বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে; আজও বৈষম্য অব্যাহত থাকায় আমরা সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক আটকে প্রতিবাদে অংশ নেয় এবং পরবর্তীতে অবরোধ ঘোষণা করে রাজধানীকে অচল করার হুঁশিয়ারি দেয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসের মূল ফটক থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হয় এবং প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে হলেও কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এনসিপির নেতারা শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন এবং রংপুর, গাইবান্ধা, রংপুর সদরে পথসভায় অংশ নেন।
এছাড়া বিকেলে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় সব রাজনৈতিক দল, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের পরিবার অংশগ্রহণ করে। সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় একতাবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব উঠে আসে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থান শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র আন্দোলন থেকে দেশে নতুন করে সামাজিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার অগ্রযাত্রায় রূপ নেয়। কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ আন্দোলন সরকারের শাসন ব্যবস্থার উপর চাপ তৈরি করেছে এবং সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পদ্ধতিতে সংস্কার আনার দাবি ত্বরান্বিত করেছে।
তাছাড়া এই আন্দোলন তরুণ সমাজকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অধিকতর ন্যায়বিচার ও সমতার প্রস্তাব সামনে এনেছে। কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই আন্দোলন এখনো দেশে যুব সমাজের অধিকার ও সমতার লড়াইয়ের প্রতীক।
এক বছর পর, ২০২৫ সালের ১ জুলাই, এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় এক তরুণ সমাজের অভূতপূর্ব সংগ্রাম ও সংকল্পের কথা, যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে একযোগে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ