
ছবি: সংগৃহীত
বিদ্যুৎ খাতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষা এবং নীতিগত অস্থিরতা—এই তিনটি বিষয়ের সংঘাতে বাংলাদেশ এখন একটি নতুন জ্বালানি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বহু প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভাবনা থাকার পরও রাজনৈতিক বিবেচনা এবং প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে বাতিল হয়ে গেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেওয়া মোট ৩৭টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৩,২৮৭ মেগাওয়াট, যার পেছনে বিনিয়োগকারীদের অনুমানিত ব্যয় ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ইতোমধ্যে ৩০ কোটি ডলার প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যয় হয়ে গেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, সোমবার (১ জুলাই) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র একটি গোলটেবিল আলোচনায় উঠে এসেছে এসব প্রকল্প বাতিলের বহুমাত্রিক প্রভাব—বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা ও আস্থাহীনতা, যার ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ হুমকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
আলোচনার বিষয় ছিল—‘বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ : অগ্রগতির পথ’। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, চাইনিজ এন্টারপ্রাইজ অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের সভাপতি হান কুনসহ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা।
সিপিডির গবেষক আবরার আহমেদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনাময় একটি গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। তবে হঠাৎ করে এতো বৃহৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগবান্ধব দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চীনা বিনিয়োগকারীরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন কারণ বাতিল হওয়া ৩৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৪টি চীনা কোম্পানির মালিকানাধীন, এবং এদের মধ্যে কয়েকটি ইতোমধ্যেই জমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ অগ্রগামী ব্যয় সম্পন্ন করেছে।
চাইনিজ ইনভেস্টর্স ইন বাংলাদেশের সভাপতি হান কুন বলেন, “চীনা কোম্পানিগুলো এশিয়ার নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রায় ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ ধরে রেখেছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে আমরা উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছি, কারণ আমরা বিশ্বাস করি—বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তর ভিশনে চীন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।”
তবে প্রকল্প বাতিলের বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার বড় সংকট তৈরি করেছে। হান কুন আরও জানান, বাতিল হওয়া প্রকল্পগুলোর অন্তত ১৫টি কোম্পানি জমি অধিগ্রহণ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে। অথচ এখন তারা জানেন না তাদের বিনিয়োগ কীভাবে রক্ষা পাবে, বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কীভাবে এগোবে। তিনি শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং উভয়পক্ষের অংশগ্রহণে একটি মধ্যমপন্থার আহ্বান জানান।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতে যে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা উচ্চাভিলাষী হলেও বাস্তবায়নযোগ্য। তবে তার জন্য প্রয়োজন সহায়ক নীতি, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তিগত সমন্বয়। আজ পর্যন্ত আমরা দেখছি, প্রকল্প শুরু করতে হলে একাধিক ওয়েবসাইটে ঘুরতে হয়, একাধিক দপ্তরে যেতে হয়, কোথাও অনলাইন পোর্টাল নেই। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন।”
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল সেবার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর মাত্র ৫০ শতাংশ ডিজিটাল, বাকি অংশ এখনও ম্যানুয়াল কাগজে-কলমে চলে। এতে সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক দক্ষতা—সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “সরকার যদি বাস্তবিক অর্থে নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে চায়, তাহলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-কে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দিতে হবে। বিডা চাইলে এক স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ঝামেলামুক্ত করতে পারে।”
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের কিছু অভিযোগও গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেকেই জমিতে বিনিয়োগ করে এখনো জমির দখল পাননি, কেউ বিদ্যুৎ বিভাগের নির্ধারিত অনুমোদন পেলেও পরে তা বাতিল করা হয়েছে। কেউ আবার জমি ছাড়তে চেয়েও অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। ফলে এসব ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক বার্তা পাঠাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুতের সরবরাহ ঘাটতি বাড়ছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস ও ডিজেলনির্ভর কেন্দ্রগুলো বারবার বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে বিকল্প শক্তির দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় সৌর বিদ্যুৎ একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প। কিন্তু এর বিস্তারে প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বক্তারা বলেন, “একদিকে আমরা বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা বলছি, অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাতিল করছি—যেখানে চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৈশ্বিক শক্তির বিনিয়োগ ছিল। এর ফলে একদিকে যেমন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা দুর্বল হচ্ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ছে।”
সিপিডির এই গোলটেবিল আলোচনায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, নবায়নযোগ্য শক্তি খাতকে নিয়ে বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। তবে বিনিয়োগের টেকসইতা নিশ্চিত করতে হলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়, বরং দরকার প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, নিয়ন্ত্রক সমন্বয় এবং নীতিনির্ধারণে স্থিতিশীলতা।
চীনের মতো কৌশলগত বিনিয়োগকারী যদি আস্থাহীনতায় ভোগে, তাহলে তা শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত নয়—বাংলাদেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশকেই অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতে পারে। সিপিডির এই আলোচনার মূল বার্তাই ছিল—নীতিগত অস্থিরতা ও প্রকল্প বাতিলের সংস্কৃতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে সরকারকে বিনিয়োগবান্ধব কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ