
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নতুন করে আস্থাহীনতা প্রকাশ করেছে ইরান, বিশেষ করে চলমান যুদ্ধবিরতি নিয়ে। ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শত্রুদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস না থাকায় তারা সম্ভাব্য নতুন আক্রমণের জবাব দিতে পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত সময় পার করা মধ্যপ্রাচ্যে, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাত নতুন করে আবার শুরু হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
রোববার (২৯ জুন) ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান–এর সঙ্গে এক ফোনালাপে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই ফোনালাপের সময় তিনি সরাসরি ইসরাইল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ভবিষ্যতে আগ্রাসন হলে কঠোর জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেন।
মুসাভি বলেন, “আমরা শত্রুদের প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে যুদ্ধবিরতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে পুরোপুরি সন্দিহান। অতীতে তাদের আচরণ থেকেই স্পষ্ট—তারা কখনোই কোনো আন্তর্জাতিক নিয়ম মানে না। অতএব, আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমরা প্রতিক্রিয়া জানাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।”
তিনি আরও বলেন, “যখন ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর হামলা চালায়, তখনও আমরা পারমাণবিক আলোচনায় যুক্ত ছিলাম। এমনকি তখনো তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন ভেঙেছে। এটি প্রমাণ করে, এই শক্তিগুলো আলোচনার ছত্রছায়ায় হামলার পরিকল্পনা করে, এবং কখনোই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না।”
মুসলিম বিশ্বে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উষ্ণ হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ নিশ্চিত করেছে, দুই প্রতিরক্ষা প্রধান ‘এই অঞ্চলের সর্বশেষ নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের আগ্রাসনের মুখে আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে তুলতে ইরান এখন কৌশলগতভাবে সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়।
গত ১৩ জুন হঠাৎ করেই ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। এরপর টানা ১২ দিন ধরে ইসরাইল তেহরানের সামরিক ঘাঁটি, পারমাণবিক স্থাপনা এবং আবাসিক এলাকায় একের পর এক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এসব হামলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাতানজ, ফোরদো ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত।
এই অভিযানে ইসরাইলের সরাসরি সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। ২২ জুন পর্যন্ত এই অভিযান চলে, যার মধ্যে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকেও পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা বর্ষণ করা হয়।
এরপর ২৪ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর মধ্যস্থতায় এক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় ইসরাইল ও ইরান। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে ইরান প্রকাশ্য সন্দেহ জানালো।
ইসরাইলের আক্রমণের পরই ইরান জবাব দেয় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি)–এর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ট্রু প্রমিজ থ্রি’ অপারেশনের মাধ্যমে। এই প্রতিশোধমূলক অভিযানে ইরান একযোগে ২২টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ইসরাইলের বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় এবং শহরাঞ্চলে আঘাত হানে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর প্রকাশিত হয়, যদিও ইসরাইল ক্ষতির পরিমাণকে গোপন রাখে।
এই পাল্টা হামলার ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করতে পারত, তবে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে আপাতত একটি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে বিরতি টানা হয়। তবে ইরান স্পষ্ট করেছে, তারা এ বিরতিকে স্থায়ী বলে ধরে নিচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের এই বক্তব্য কেবল সামরিক প্রস্তুতির বার্তা নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের প্রতি একটি কৌশলগত অনাস্থা প্রকাশও। ইরান বারবার অভিযোগ করে আসছে যে, পশ্চিমা দেশগুলো আলোচনার নামে আসলে নিজেদের সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে যায়।
আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের এমন সরাসরি সামরিক স্তরের আলোচনা আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের জিও-পলিটিক্যাল রসায়নে নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে পারে। এরই মধ্যে চীনও মধ্যস্থতার ভূমিকায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। পারমাণবিক আলোচনার টেবিলে বসে আবারও সামরিক আগ্রাসন চালানোয় ইরানের দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব দেশের ওপর আস্থার জায়গা নেই বললেই চলে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ইরানের সামরিক নেতৃত্ব থেকে পরিষ্কার ইঙ্গিত মিলেছে—নতুন আক্রমণ হলে দেশটি পুরো শক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেবে। এদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে ইসরাইলের একক আধিপত্যের দিন হয়তো শেষ হতে যাচ্ছে।
সূত্র: আনাদোলু, এসপিএ, আইআরএনএ
বাংলাবার্তা/এমএইচ