
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ পুলিশের শীর্ষ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ৪২৪টি পদ দীর্ঘ ১০ মাস ধরে শূন্য পড়ে থাকায় গোটা বাহিনী কার্যত চরম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ কারণে শুধু বাহিনীর প্রশাসনিক কার্যক্রমই নয়, অপরাধ দমন ও তদন্তের কার্যকারিতাও উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৯টি অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল আইজিপি), ৩৪টি উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), ২টি অতিরিক্ত ডিআইজি, ৪৭টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত এসপি) ও ৩৩২টি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদ শূন্য রয়েছে। এর বাইরে আরও ১১৯ জন ডিআইজি ও এসপি স্তরের কর্মকর্তাকে কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব না দিয়ে শুধু ইউনিটে ‘সংযুক্ত’ রাখা হয়েছে, অর্থাৎ তারা নিয়মিত ফাইলসই করছেন, কিন্তু মাঠে কোনো দায়িত্ব পালন করছেন না।
২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশের বিরুদ্ধে দায় চাপিয়ে গণআন্দোলনের সময়ের বিভিন্ন নির্যাতন, গুম, গ্রেপ্তার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ব্যাপক আকারে উঠে আসে।
এরপর থেকে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তাকে ২৫ বছরের চাকরি পূর্ণ হওয়ার পর অবসর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২৩ জন এএসপি ও তার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
এছাড়া অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে এএসপি পর্যন্ত ৫৭ জন কর্মকর্তা ৬০ দিনেরও বেশি সময় ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত, যা এই মুহূর্তে বাহিনীর কাঠামোগত দুর্বলতার সবচেয়ে বড় চিত্র।
সদর দপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, অনেক কর্মকর্তা শুধুমাত্র ‘সংযুক্ত’ অবস্থায় থাকায় তারা প্রাত্যহিক দায়িত্ব পালন করছেন না। এ নিয়ে বাহিনীর ভেতরে হতাশা, অনিশ্চয়তা এবং পদোন্নতি-পোস্টিং নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অতিরিক্ত এসপি বলেন, “বর্তমানে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যেন মুখ্য বিষয় নয়, বরং আমাদের উদ্বেগ এখন কোন ইউনিটে কে যাচ্ছে, কে পদোন্নতি পাচ্ছে তা নিয়েই বেশি।”
একজন ডিআইজি বলেন, “আমার চেয়ে জুনিয়র অফিসাররা এখন আমার ওপরে পোস্টিং পাচ্ছেন। যদি আর পদোন্নতি না হয়, তাহলে এখানেই আমার ক্যারিয়ার শেষ।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, “পদোন্নতি, বদলি ও শূন্য পদ পূরণ একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। আমরা ঈদ-পূজার সময়গুলোতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেছি সফলভাবে। বড় কোনো অপরাধ বা বিশৃঙ্খলার খবর নেই।”
তবে তিনিও স্বীকার করেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর বাহিনী কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে কাজ করছি।”
দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকার প্রভাব পড়ছে জেলা ও থানাভিত্তিক তদন্ত এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি ঢাকার ছয়টি থানায় ঘুরে দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যম বা কোনো উচ্চ পর্যায়ের নজরদারি ছাড়া বেশিরভাগ অভিযোগ রেকর্ডই হচ্ছে না।
মিরপুর-১১ এলাকায় ২২ বছর বয়সী রকিবুল হাসানকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এবং শরীরে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মা রোজিনা বেগম জানান, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা আগে থেকেই তার ছেলেকে হুমকি দিচ্ছিল। পুলিশ থানায় অভিযোগ নিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
একইভাবে ৩১ মে দারুস সালাম এলাকায় দুই সন্দেহভাজনকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ঘটনাস্থলে যায়নি। থানার ওসি দাবি করেন, “সব ফোন কলই রিসিভ করা হয় এবং অভিযান চালানো হয় নিয়মিত।”
গত ২৬ মে বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধন রাজধানীর বাড্ডায় গুলি খেয়ে নিহত হন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
তেমনি, ১৪ মে নিখোঁজ এক শিশুর বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার হয়। মা তেজগাঁও থানায় মামলা করলেও আজ পর্যন্ত পুলিশ কোনো সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
বাংলাদেশ পুলিশ এখন প্রশাসনিক শূন্যতা, তদন্তে স্থবিরতা ও অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা রক্ষায় বাহিনীর সক্ষমতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুরবস্থা কাটাতে হলে অবিলম্বে শূন্য পদ পূরণ, সংযুক্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান, এবং রাজনৈতিক নয়—যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে, পুলিশ বাহিনী জনআস্থার বাইরে চলে যেতে পারে, যার ফলাফল হবে ভয়াবহ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ