
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাকে ফের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। শুক্রবার (২৭ জুন) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আওলাদ হোসাইন মুহাম্মদ জোনাইদ এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এটি এই মামলায় তার দ্বিতীয় দফা রিমান্ড।
শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামসুজ্জোহা সরকার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে এদিন আদালতে নূরুল হুদাকে হাজির করে তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানির পর বিচারক চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে গত সোমবার (২৩ জুন) একই মামলায় তাকে প্রথম দফায় চার দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছিল। সেই রিমান্ড শেষে আজ তাকে আবার আদালতে হাজির করা হয়।
নূরুল হুদাকে শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে আদালতে আনা হয়। এর আগে থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিল, কারণ মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং রাজনৈতিকভাবে উচ্চমার্গে আলোচিত। আদালতের ভেতরে ও বাইরে উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
আদালতে শুনানির সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড আবেদন বাতিল করে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। তারা বলেন, “নূরুল হুদা একজন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী আদালতের কাছে আসামির সর্বোচ্চ রিমান্ড প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, “এই মামলাটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেহেতু তিনি একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, তার ভূমিকা রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে কি না, সেটি তদন্তের স্বার্থেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।”
শুনানি শেষে আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে রায় ঘোষণা করেন।
এই মামলা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন। কারণ এতে একসঙ্গে তিনজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন খান গত রোববার (২২ জুন) শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা তিনজন সিইসি—কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কেএম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল—"রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অপব্যবহার করে একাধিক প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করেন, যা গণতন্ত্রবিরোধী এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণের শামিল।"
এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীতে উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’র (মব) হাতে হেনস্তার শিকার হন নূরুল হুদা। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে এবং গ্রেফতার দেখায়। এরপর থেকেই শুরু হয় এই মামলার আইনি প্রক্রিয়া।
মামলার আরেক প্রধান আসামি, ২০২৪ সালের নির্বাচন পরিচালনাকারী তৎকালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকেও এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে গত বুধবার গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার তিন দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। মামলার অপর আসামি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে এখনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়নি, তবে তদন্তকারীরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে বিরল। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম স্বাধীন ও স্বশাসিত হলেও নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্বে ‘বিকল্প মতলবে’ কোনো কাজ করা হলে তার পরিণতি নিয়ে আগে কখনো এমন বিচারিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, “এই মামলার পরিণতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক বিচারিক দৃষ্টান্ত হিসেবেও ইতিহাসে স্থান করে নেবে।”
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “দেশে ভোটাধিকার হরণের জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল অপরাধমূলক। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে অভিযোগ করে আসছি, এবার জনগণের প্রতিরোধের ফলেই এই মামলা হয়েছে।”
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি, তবে ঘনিষ্ঠ মহলে এ ঘটনায় নীরব সমর্থনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ফলে, নূরুল হুদাকে দ্বিতীয়বারের মতো রিমান্ডে নেওয়ার মাধ্যমে মামলাটি নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। এটি শুধু একজন ব্যক্তির বিচারের প্রশ্ন নয়, বরং গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব নিয়েও জাতীয় স্তরে গভীর আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ