
ছবি: সংগৃহীত
থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে বুধবার ছিল এক অনন্য দিন—কারণ, দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব পালন করলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মাত্র একদিনই থাকবেন সেই পদে। অভিজ্ঞ থাই রাজনীতিবিদ এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী সুরিয়া জুংরুংরুয়াংকিত এক দিনের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান, যা অনেকটা সিনেমার গল্পের মতো শোনালেও, বাস্তব রাজনৈতিক ঘটনাবলির ধারাবাহিকতায় ঘটেছে।
থাইল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা-কে মঙ্গলবার (১ জুলাই) সাময়িক বরখাস্ত করে দেশটির সাংবিধানিক আদালত। এর ফলে, তাঁর স্থলে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী সুরিয়াকে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বুধবার সকাল থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের জন্য দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেন এই ৭০ বছর বয়সী প্রবীণ রাজনীতিবিদ, যিনি থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয়।
সাংবিধানিক আদালতের বরাতে থাই গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, কম্বোডিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপড়েন তৈরি হওয়া একটি ঘটনায় পেতংতার্নের ভূমিকা তদন্তাধীন। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত নৈতিক আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, এমন ‘যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ’ রয়েছে।
তবে আদালতের সিদ্ধান্তের পেছনে মূল চালিকা শক্তি ছিল এক ফাঁস হওয়া ফোনালাপ, যেখানে পেতংতার্ন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে “চাচা” বলে সম্বোধন করেন এবং এক থাই সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন। এই ফোনালাপ থাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং এরপর থেকেই তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।
বুধবার সকালে সুরিয়া ব্যাংককে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তার সংক্ষিপ্ত প্রধানমন্ত্রীত্বের কর্মদিবস শুরু করেন। এই অনুষ্ঠানটি ছিল থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্থাপনের ৯৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত।
মজার বিষয় হলো, সুরিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কাল ৯৩ ঘণ্টাও নয়, অথচ সেই কার্যালয়ের ৯৩তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করতেই তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিতে হয়।
এই প্রতীকী সাদৃশ্য নিয়ে সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জানতে চাইলে, সুরিয়া মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। বরং তিনি বলেন, “আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো একটি কাগজে সই করা, যার মাধ্যমে আমি আমার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে উত্তরসূরির কাছে হস্তান্তর করতে পারি।”
থাই রাজনীতির দীর্ঘদিনের চেনামুখ সুরিয়া। একাধিক সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তিনি “যেদিকে হাওয়া, সেদিকেই থাকা”য় পারদর্শী। ক্ষমতাসীন দল পরিবর্তন হলেই তাঁর আনুগত্যের অভিমুখও পরিবর্তিত হয়—এমন সমালোচনাও আছে গণমাধ্যমে।
তবে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযাত্রা এবং দলবদলের অভিজ্ঞতার কারণে সুরিয়া থাইল্যান্ডের প্রশাসনিক চক্রে একজন অভিজ্ঞ সংগঠক ও কৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত। তাই তাঁর অস্থায়ী দায়িত্ব পালন হলেও এটি গুরুত্বহীন ছিল না।
পেতংতার্নকে সাময়িক বরখাস্ত করার আগে তাঁর সরকারের মন্ত্রিসভা রদবদলের পরিকল্পনা ছিল। এই রদবদল বাস্তবায়ন ও নতুন মন্ত্রীদের শপথের প্রস্তুতিই ছিল সুরিয়ার অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রিত্বের মূল কাজ।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) এই শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন মন্ত্রী ফুমথাম উইচায়াচাই থাইল্যান্ডের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। ক্ষমতাসীন ফেউ থাই পার্টি জানিয়েছে, ফুমথামকে সহকারী প্রধানমন্ত্রী পদেও উন্নীত করা হবে, যা উপ-প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর পদমর্যাদা।
এ কারণেই সুরিয়ার অস্থায়ী দায়িত্ব আর বাড়ানো হয়নি—তিনি কেবল নতুন রদবদল পর্বের সংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় মাত্র এক দিনের জন্য দায়িত্বে ছিলেন।
‘এক দিনের প্রধানমন্ত্রী’ শুনতে মজার মনে হলেও, এটি থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। রাষ্ট্রক্ষমতার হস্তান্তর ও কার্যকারিতায় যাতে কোনো ভ্যাকুয়াম না থাকে, সেজন্যই এই সাময়িক নিয়োগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা একদিকে যেমন থাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অস্থিরতাকে প্রতিফলিত করে, অন্যদিকে সাংবিধানিক ব্যবস্থার তৎপরতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ইচ্ছাকেও প্রকাশ করে।
দিন শেষে সবার নজর ছিল এই প্রশ্নে—সুরিয়া কি কোনো নতুন চমক দেখাবেন, নাকি নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করে নিজের ‘এক দিনের’ প্রধানমন্ত্রিত্ব ইতিহাসে তুলে রাখবেন?
যদিও দিন শেষে কোনো নাটকীয়তা বা চমক দেখা যায়নি, তবে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি ‘প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একদিনের জন্য’—এই ব্যতিক্রমী পরিচয়ে স্থান করে নিল চিরপরিচিত নাম সুরিয়া জুংরুংরুয়াংকিত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ